শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বছরজুড়েই মাদকের বিস্তার

আলী আজম

বছরজুড়েই মাদকের বিস্তার

বছরজুড়ে ছিল মাদকের বিস্তার। আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে বিদায়ী বছরে মাদকের বিস্তার ঘটেছে কয়েক গুণ। সরকার ও সমাজের সর্বোচ্চ ক্ষমতাসীন বহু মানুষ এমনকি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মাদক ব্যবসা বা পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার খবর প্রকাশ হয় এ বছর। ক্ষেত্রবিশেষ কর্তৃপক্ষের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মাদকের বিস্তার ঘটেছে বিদায়ী বছরে। রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে অনেকেই নিজেদের আড়াল করে রাখেন। আর লোক দেখানো গ্রেফতার চলেছে আগের মতোই।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে ৪৪১ কেজি ২২১ গ্রাম হেরোইন, ৫ লাখ ৭৪ হাজার ৩০১ বোতল কোডিনমিশ্রিত ফেনসিডিল, ১০৬ কেজি ৬০৮ গ্রাম তরল ফেনসিডিল, ৮৬ হাজার ৬৯৬ কেজি ২৮১ গ্রাম গাঁজা, ১ কেজি ৫৫ গ্রাম কোকেন, ৫ কোটি ৩০ লাখ ৭৩ হাজার ৬৬৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ও ৪৮ হাজার ৬২৬টি অ্যাম্পুল ইনজেকশন উদ্ধার করা হয়। এ সময় মামলা হয়েছে ৯৩ হাজার ১৯০টি এবং আসামি গ্রেফতার হয়েছেন ১ লাখ ২২ হাজার ১৫২ জন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, কাস্টমস ও বাংলাদেশ কোস্টগার্ড সমন্বিত অভিযানের ফলাফল এটি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনার প্রভাব কাটিয়ে ২০২২ সালে বিভিন্ন প্রকারের মাদকদ্রব্য ধরা পড়েছে কয়েক গুণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে সারা দেশে সেবনকারীরা প্রতিদিন গড়ে ২০ কোটি টাকার নেশা গ্রহণ করছে। বছরের হিসাবে এর পেছনে খরচ হয় আনুমানিক ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এ ব্যবসায় জড়িত ২০০ গডফাদার ও বিক্রির নেটওয়ার্কে কাজ করে ১ লাখ ৬৫ হাজার জন। প্রতি বছরই বাড়ছে এ সংখ্যা। মাদকদ্রব্য লেনদেনের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে। নেশাজাতীয় দ্রব্যের বিস্তারের এই সর্বনাশা চিত্র যেভাবে আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতি করছে, সেভাবে একটি প্রজন্মের চিন্তার জগতে বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি করছে। দীর্ঘমেয়াদে এর ফল ভয়াবহ হবে। তারা আরও বলছেন, উঠতি বয়সী যুবকরা বিশেষ করে স্কুল-কলেজগামী ছেলেরা এ মরণ নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। পারিবারিক অশান্তি, বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, বন্ধুদের প্ররোচনা, অসৎ সঙ্গ, নানারকম হতাশা ও আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে তারা। যারা নেশা করে তারা জানে নেশা কোনো উপকারী বা ভালো কাজ নয়। এটি মানুষের জীবনীশক্তি নষ্ট করে দেয়। ফলে আগামী প্রজন্মকে বাঁচাতে সমন্বিতভাবে কাজ করে মাদকের বিস্তার রোধ করতে হবে। সচেতনতামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করে এর কুফল সম্পর্কে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ধারাবাহিকভাবে মাদকের বিস্তার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে ইয়াবা ৪০ হাজার গুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯ সালে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার ৫৪৮ পিস হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে মাদক উদ্ধারের ঘটনায় মামলা ১ লাখ ছাড়িয়েছে। এরপর আর তা লাখের নিচে নামেনি। একইভাবে এসব মামলায় আসামির তালিকাও ২০১৭ সাল থেকে ১ লাখের ওপরে গেছে। তালিকা ক্রমেই বড় হচ্ছে। যদিও এ হিসাবকে সাফল্য হিসেবে দেখছে উদ্ধারসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকের বিস্তার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধির কারণে ধরাও পড়ছে বেশি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশনস) তানভীর মমতাজ বলেন, মাদকের বিস্তার রোধে প্রতি মাসে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বড় বড় সামাজিক অনুষ্ঠান কেন্দ্র করে অপারেশনাল কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে র‌্যাব সর্বদা জিরো টলারেন্স। এ পর্যন্ত ১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মাদকের বিস্তার রোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমরা মাদকের কুফল উল্লেখ করে লিফলেট বিতরণসহ স্কুল-কলেজে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সচেতন করছি।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. মনজুর রহমান বলেন, মাদকবিরোধী অভিযান নিয়মিতই চালানো হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিশেষ অভিযান চালানো হয়। মাদক উদ্ধার এবং এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণ একটা মাল্টি অর্গানাইজেশনাল টাস্ক। বিভিন্নভাবে মাদক আসছে। এটা নিয়ে আরও বেশি কাজ করতে হবে। মাদক রুখতে সবার সহযোগিতা ও সচেতনতার বিকল্প নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, বছরজুড়ে মাদকের উপস্থিতি লক্ষ করেছি সেটি নানা দিক দিয়ে ভয়ের ও শঙ্কার কারণ। যেসব উৎস থেকে বাংলাদেশে মাদক আসছে সেসব উৎস বন্ধ করতে হবে। মাদকের পৃষ্ঠপোষকদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। যারা ইতোমধ্যে মাদকে জড়িয়ে পড়েছে তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর