করোনা মহামারির সংকট কাটার আগেই শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে ফেললেও মেগা প্রকল্পগুলোর কাজে তেমন বড় কোনো প্রভাব পড়েনি। এ বছরই চালু হয়েছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প। উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে মেট্রোরেল লাইন-৬। কাজ প্রায় শেষের দিকে কর্ণফুলী টানেলের। এ ছাড়া বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ স্থাপন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পসহ মেগা প্রকল্পগুলোর কাজে বিদায়ী বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
চলতি বছর ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। দেশে দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নে এ সেতু অসামান্য অবদান রাখছে। এ অঞ্চলের অন্তত ১৯টি জেলার অর্থনীতিতে যোগ করেছে নতুন সম্ভাবনা। একইভাবে উদ্বোধনের প্রহর গুনছে যোগাযোগ খাতের স্বাপ্নিক আরেক প্রকল্প মেট্রোরেল লাইন-৬। এ ছাড়া চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন কর্ণফুলী টানেলের কাজ রয়েছে শেষ পর্যায়ে। এ ছাড়া মেট্রোরেল লাইন-১ তথা পাতালরেলের কাজও শুরু হতে যাচ্ছে শিগগিরই।
অথচ ২০২২ সালের একেবারে গোড়ার দিকে করোনা মহামারির ধাক্কা কাটানোর আগেই ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তরতর করে বেড়ে যায় জ্বালানির দাম। এতে করে দেশের বাজারেও সব ধরনের পণ্যমূল্য বেড়ে যায়। এতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নেও ব্যাপক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হয়। এমনকি প্রভাব পড়েও। তবে মেগা প্রকল্পগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে সরকার। এসব প্রকল্প বাদে এডিপির অন্যান্য প্রকল্পে অর্থ ছাড়ের বিষয়ে ধীরগতি নীতি অবলম্বন করা হয়, যা শেষ পর্যন্ত বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন বিশ্লেষক ও সরকার-সংশ্লিষ্টরা।আর মাত্র ২৪ ঘণ্টা, আগামীকাল যাত্রী চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে মেট্রোরেল লাইন-৬। বৃহৎ এই প্রকল্পের একাংশ দিয়াবাড়ী থেকে আগারগাঁও উদ্বোধনের জন্য সময় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিজয়ের মাস হিসেবে ডিসেম্বরের সঙ্গে বাঙালি জাতির আলাদা অনন্য এক আবেগ, অনুভূতি জড়িত। আর এই ডিসেম্বর মাসকেই বেছে নেওয়া হয়েছে মেট্রোরেল উদ্বোধনের জন্য। উদ্বোধন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে। এ প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্যে করোনাকালের ক্ষতি পোষাতে এ বছর দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ করেছেন শ্রমিক, প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্টরা।
সেতু বিভাগের তথ্যমতে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দক্ষিণ সুড়ঙ্গের (টিউব) পূর্তকাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এই সুড়ঙ্গ চট্টগ্রামের আনোয়ারা প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে নগরের পতেঙ্গা প্রান্ত পর্যন্ত, যা এখন যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত। এ ছাড়া উত্তর সুড়ঙ্গের (পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারামুখী) অংশের কাজও প্রায় শেষ। কাজ পুরো শেষ হলে টানেলটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। আগামী বছরের শুরুতেই এ প্রকল্প উদ্বোধন করা সম্ভব হবে বলে মনে করে সরকার। এ প্রকল্পের মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। দুই সুড়ঙ্গে দুটি করে মোট চারটি লেন রয়েছে। আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ উড়ালসড়ক। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার। টানেল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। করোনা মহামারিকালে প্রকল্পের কাজে কিছুটা ধীরগতি বিরাজ করে। পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও এ প্রকল্পকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বেছে নিয়ে কাজ চালিয়ে গেছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এদিকে বৈশ্বিক মন্দা ও দেশে চলমান অর্থ সংকটের তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পে। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে এর কাজ। এই টার্মিনালে থাকবে নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া। ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটারের এই বিমানবন্দরটির নকশা করেছেন বিখ্যাত স্থপতি রোহানি বাহারিন। টার্মিনালের নির্মাণকাজ ইতোমধ্যে ৫১ ভাগ শেষ হয়েছে। ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে এই টার্মিনাল ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে যখন সরকারের বেশ কিছু বড় প্রকল্পের কাজ চলমান রাখা সম্ভব হয়নি, তখনো থামেনি স্বপ্নের এই টার্মিনালের নির্মাণকাজ। সব বিধিনিষেধ মেনেই কাজ চালিয়ে গেছেন কর্মীরা। এই টার্মিনাল নির্মাণ সম্পন্ন হলে হযরত শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বছরে ২ কোটি যাত্রীকে সেবার আওতায় আনা সম্ভব হবে। বর্তমানে বিমানবন্দরটি বছরে ৮০ লাখ যাত্রীকে সেবা দিয়ে আসছে।
এদিকে বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজে নানা জটিলতা থাকলেও চলতি বছর বেশ জোরেশোরেই এগিয়েছে। তবে নির্ধারিত সময়ে শেষ করা সম্ভব হয়নি। এ প্রকল্পের জন্য নতুন সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে নির্মাণকালের দিক থেকে সবচেয়ে দীর্ঘায়িত বিআরটি প্রকল্পের একটি অংশ যান চলাচলের জন্য ইতোমধ্যে খুলে দেওয়া হয়েছে। বাকি অংশের কাজ চলমান। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যন্ত্রপাতি আমদানিতে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজে কিছুটা ধীরগতি পরিলক্ষিত হলেও বছরের শেষ দিকে এ প্রকল্পের কাজে স্বাভাবিক গতি ফিরেছে। আশা করা হচ্ছে নির্ধারিত সময়েই এ প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হবে।