শুক্রবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভোগান্তির শেষ নেই এনআইডি সংশোধনে

চট্টগ্রাম

আজহার মাহমুদ, চট্টগ্রাম

‘মুক্তিযুদ্ধের পরে, ১৯৭৫ সালে আমার জন্ম। কিন্তু এনআইডি করার সময় নিবন্ধনকারীদের ভুলে জন্ম সাল ১৯৬৪ উল্লেখ করা হয়। এতে প্রকৃত বয়সের চেয়ে আমার বয়স ৯ বছর বেড়ে যায়। ফলে সৌদি কোম্পানি আমাকে আর চাকরিতে রাখছে না। দেড় বছর আগে বাড়ি ফিরে এনআইডি সংশোধনের আবেদন করেছিলাম। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে শতবার নির্বাচন কমিশনে এলেও এনআইডি সংশোধন করতে পারিনি।’

চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের বাসিন্দা প্রবাসী মো. জাকারিয়া গত সপ্তাহে এভাবে বলছিলেন তার নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশোধনে ভোগান্তির কথা। এনআইডিতে বাড়তি বয়সের কারণে প্রবাসে চাকরি হারানো এ রেমিট্যান্স যোদ্ধা জানান, তার তিন কন্যা। এর মধ্যে দুজনের বিয়ের প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু নির্বাচন অফিসের ভুলে সব এলোমেলো হয়ে গেছে। চাকরি চলে যাওয়ার কারণে তিনি গভীর আর্থিক সংকটে পড়তে যাচ্ছেন।

জাকারিয়া বলছিলেন, ‘গত দেড় বছরে অন্তত ১০০ বার নির্বাচন অফিসে গিয়ে চাহিদা অনুযায়ী সব কাগজপত্র সরবরাহ করেছি। কিন্তু বয়সটা সংশোধন করতে পারিনি। প্রতিবারই নতুন নতুন শর্ত দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। চাকরি হারিয়ে দেশে এসে না পারছি নতুন কিছু করতে, না পারছি বিদেশ যেতে।’

পাকু দাশ নামে আরেকজনের এনআইডি অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ১৯৫৫ সালের ২০ এপ্রিল। কিন্তু তার মা রাধা রাণীর এনআইডি অনুযায়ী ছেলে পাকুর জন্মের ১৩ বছর ৩ মাস পর অর্থাৎ ১৯৬৮ সালের ৩ আগস্ট পাকুর মায়ের জন্ম হয়। এর মানে দাঁড়াচ্ছে- পাকু তার মায়ের চেয়ে ১৩ বছরের বড়। শুনতে অবাক লাগলেও এমন ঘটনারও জন্ম দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মীরা।

কমিশনের এ ভুলে এনআইডি অনুযায়ী ৫৯ বছর পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় সম্প্রতি চাকরি হারান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক) কর্মরত পাকু। শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ না থাকায় নিজের এনআইডি সংশোধনের জন্য কমিশনের দ্বারে ঘুরেও কোনো ফল পাচ্ছেন না পাকু। পরে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর পাকুর এনআইডি সংশোধন করে দেওয়া হয। গত ৪ জানুয়ারি পাকু চাকরি ফিরে পান।

জাকারিয়া কিংবা পাকুর মতো লাখো আবেদনকারী সারা দেশে এনআইডি              সংশোধন নিয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে আছেন। চট্টগ্রামও এর ব্যতিক্রম নয়। ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়নের পর থেকে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। দফায় দফায় চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ে গিয়ে নাগরিকদের নানা ধরনের ভোগান্তির চিত্র পাওয়া গেছে। কারও নামের ভুল, কারও বয়সের, কারও পিতা-মাতার নামে ভুলসহ নানা ধরনের অসঙ্গতি ঠিক করতে কমিশনের কার্যালয়ে ধরনা দিচ্ছেন তারা। অনেকে সব দলিল সরবরাহের পরও দিনের পর দিন অদৃশ্য কারণে এনআইডি সংশোধন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এর বিপরীতে কেউ কেউ নির্বাচন কার্যালয়ের অসাধু কর্মচারী অনৈতিক সুবিধা দিয়ে দ্রুত সময়ে এনআইডি সংশোধন করে নিচ্ছেন। এসব কাজের জন্য গড়ে উঠেছে দালাল চক্র। চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী এলাকার রিকশাচালক নুর মিয়া জানান, ২০০৮ সালে ভোটার হলেও তার এনআইডি কার্ডটি হারিয়ে ফেলেন। কয়েকদিন আগে এক দালালের হাত ধরে নির্বাচন অফিসে এসেছিলেন পুনরায় এনআইডি সংগ্রহের জন্য। তিনি ওই দালালের সঙ্গে ৩ হাজার টাকার চুক্তি করেন। কাজ শেষ হলে আরও ১ হাজার টাকা দিতে হবে। আরেক আবেদনকারী জানান, তিনি ১৯৭০ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিলেও সার্টিফিকেট হারিয়ে ফেলেন। সার্টিফিকেট ছাড়া নাম সংশোধন না হওয়ায় তিনি বিপাকে পড়েছেন। কিন্তু শিক্ষাবোর্ড ৯০-এর আগের কোনো সার্টিফিকেট না থাকায় সেটিও পাচ্ছেন না তিনি।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, নাগরিকদের ভোগান্তি কমাতে গত ২৬ জুলাই মাঠ পর্যায়ে অযৌক্তিক দলিলাদি চাওয়া থেকে বিরত থাকতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও ভোগান্তি কমেনি। বেশির ভাগ আবেদন অবহেলায় পড়ে থাকছে। উপজেলায় সব কাগজপত্র জমা দিয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা শেষে আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ে এসে ধরনা দিচ্ছেন অনেকে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দালালদের কাছে না যেতে সবাইকে বার বার বলা হয়। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে ভোগান্তি কমানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এরই মধ্যে এনআইডি সংশোধনে অনেক গতি এসেছে। এটা কীভাবে আরও দ্রুত সময়ে শেষ করা যায় সেজন্য নির্বাচন কমিশন কাজ করছে’।

সর্বশেষ খবর