শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

উত্তাপ বাড়ছে উপনির্বাচনে

চাঁপাইনবাবগঞ্জে নৌকা ঠেকাতে বিরোধীরা মরিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান আটক, শ্যালক নিখোঁজ

প্রতিদিন ডেস্ক

বিএনপির ছেড়ে দেওয়া আসনগুলোতে উপনির্বাচনী তৎপরতা জমে উঠেছে। আসনগুলোর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ ও ৩ আসনে নৌকার বিজয় ঠেকাতে মরিয়া তৎপরতা চালাচ্ছেন বিরোধীরা। অবশ্য আওয়ামী লীগ চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ অন্য চার আসন পুনরুদ্ধার করতে নিজেদের সব ভেদাভেদ ভুলে একাট্টা হয়ে মাঠে নেমেছে। এদিকে আলোচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনের উপনির্বাচনেও আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃৃত উকিল আবদুস সাত্তারের পাশে দাঁড়িয়ে সব রকম সহায়তা দিয়ে চলেছে। এ ছাড়া গতকাল এ আসনের উপনির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদের নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান দায়িত্বে থাকা মুসা মিয়াকে (৮০) পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তার শ্যালককেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করা হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ ও ৩ আসনের উপনির্বাচনে নৌকা ঠেকাতে বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ প্রার্থীসহ বিরোধীরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। এমনকি সংসদ থেকে পদত্যাগ করা বিএনপির দুই সাবেক সংসদ সদস্য আমিনুল ইসলাম ও হারুনুর রশীদ হারুন নৌকা বিরোধী প্রার্থীদের সমর্থনে মাঠে নেমে পড়েছেন। অন্যদিকে হারানো এই আসন পুনরুদ্ধারে একাট্টা হয়ে মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গ সংগঠনের নেতারা ঘন ঘন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সফরে আসছেন এবং প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। তাদের লক্ষ্য বর্তমান সরকারের উন্নয়ন ফিরিস্তি তুলে ধরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিজয় সুনিশ্চিত করা।

আগামী ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য মুহা. জিয়াউর রহমান (নৌকা), আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী খুরশিদ আলম বাচ্চু (মাথাল), জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক (লাঙ্গল), বিএনএফের নবিউল ইসলাম (টেলিভিশন) এবং জাকের পার্টির গোলাম মোস্তফা (গোলাপ ফুল)। অন্যদিকে  চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের প্রার্থীরা হলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল ওদুদ (নৌকা), স্বতন্ত্র প্রার্থী গত পৌরসভা নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী হয়ে বহিষ্কৃৃত সাবেক যুবলীগ নেতা সামিউল হক লিটন (আপেল) এবং বিএনএফের কামরুজ্জামান (টেলিভিশন)।

জানা গেছে, নির্বাচনী ডামাডোলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে নৌকার বিজয় ঠেকাতে দলের ভিতরে ও বাইরে কতিপয় নেতা মরিয়া হয়ে উঠেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ হারুন স্বতন্ত্র প্রার্থী বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা সামিউল হক লিটনকে সমর্থন দিয়ে তার পক্ষে কাজ শুরু করায় বিএনপির একাংশের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। এনিয়ে গত বুধবার বিকালে জেলা বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশে স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ হারুন ও আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে এই নির্বাচনে দুই আওয়ামী লীগ বিদ্রোহীর পক্ষে কাজ করায় বিষোদগার করা হয়। এ ছাড়াও জামায়াতের কতিপয় নেতা গোপনে নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করছেন। তাদের লক্ষ্য যে কোনো মূল্যে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া। এদিকে নির্বাচন নিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ দলের মধ্য থেকে কতিপয় ব্যক্তি ষড়যন্ত্র করছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল ওদুদ। তিনি নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উন্নয়ন ফিরিস্তি তুলে ধরে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে নৌকার প্রার্থী মুহা. জিয়াউর রহমানকে পরাজিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী খুরশিদ আলম বাচ্চু এবং রাজশাহী জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার। আর তাদের সঙ্গে গোপনে কাজ করছেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আমিনুল ইসলাম।

তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিজয়ী করতে সব নেতা-কর্মীকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশনা প্রদান করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা সরকারি দলীয় প্রভাবশালী প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনের উপনির্বাচনে ভোটের আমেজে ভাটা পড়েছে। এমনকি আলোচিত প্রার্থী সংসদ সদস্য এবং বিএনপি থেকে পদত্যাগী ও পরবর্তীতে বহিষ্কৃত উকিল আবদুস সাত্তার ভূইয়াও মাঠে নেই। ২/১ দিন গণসংযোগের পর ঢাকায় ফিরে গেছেন প্রায় ৮৪ বছর বয়স্ক এই প্রবীণ নেতা। অবশ্য তার ছেলে পিতার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন নির্বাচনী এলাকায়। তবে উকিল আবদুস সাত্তারের প্রচার প্রচারণা করছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও জাতীয় পার্টির একাংশ। ১৯৭৯ সালে প্রথম স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হন উকিল আবদুস সাত্তার। মহাজোট থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা এবং আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র তিন প্রার্থী মঈন উদ্দিন মঈন, মাহবুবুল বারী চৌধুরী ও শাহজাহান আলম সাজু ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ানোর পর উপনির্বাচনের লড়াইয়ের হিসাব পাল্টে যায়। প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঠে থাকা চার প্রার্থীর মধ্যে নানা বিবেচনায় উকিল সাত্তার শক্তিশালী প্রার্থী হয়ে ওঠেন। তার নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা সরাসরি মাঠে কাজ করছেন। পাশাপাশি স্থানীয় বিএনপি সংসদ সদস্য ও দলত্যাগী নেতার বিপক্ষে পত্রিকায় বিবৃতি ও সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ্যে অবস্থান নিলেও বাস্তবে দলটির অধিকাংশই নেতা-কর্মীরা সাত্তারের পক্ষেই নির্বাচন করছেন। বিএনপির কমিটি নিয়ে বিরোধের কারণে দলের একটি অংশ নির্বাচনের শুরু থেকেই তার হয়ে কাজ করছে। উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সরাইল সদর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার জানান, প্রথমে দলের পদবঞ্চিতরা মাঠে নামলেও এখন বিএনপির প্রায় সবাই উকিল সাত্তারের নির্বাচন করছেন। তবে উপজেলা বিএনপির সভাপতি আনিসুল ইসলাম ঠাকুর বলেন, আমার এমন খবর জানা নেই।

উল্লেখ্য, এই আসনের উপনির্বাচনে আবদুস সাত্তারসহ চারজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। অন্য তিনজন হলেন আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি (সদ্য বহিষ্কৃত) ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু আসিফ আহমেদ, জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব আবদুল হামিদ ভাসানী এবং জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম। তাদের মধ্যে আবু আসিফ আহমেদ ও জাতীয় পার্টির আবদুল হামিদ ভাসানী সরাইল ও আশুগঞ্জে প্রচারণা চালাচ্ছেন। সেটিও খুব বেশি চোখে পড়ার মতো নয়। আর জাকের পার্টির প্রার্থীকে এখনো মাঠে দেখা যায়নি।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আবদুস সাত্তারকে বিজয়ী করার জন্য দলের নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ওই নির্দেশনার আলোকেই আওয়ামী লীগের তিন স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করানো হয়। যদিও জেলা আওয়ামী লীগ বলছে, যেহেতু ওই আসনে দলীয় প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। সে কারণে দলীয় বিভাজন রোধে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে কোনো চাপ ছিল না।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার বলেন, যেহেতু এ আসনে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী নেই এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী উকিল সাত্তার ভুইয়া একজন সৎ ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ এবং পাঁচ বারের এমপি হওয়ায় সব নেতা-কর্মী তাকে স্বাধীনভাবে সমর্থন করছেন। সুষ্ঠু ভোট গ্রহণে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন। বিএনপি ভোট বানচাল করলে তা প্রতিহত করা হবে। তিনি কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে ভোটারদের আহ্বান জানান।

এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদের নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান দায়িত্বে থাকা মুসা মিয়াকে (৮০) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত বুধবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে আশুগঞ্জ পূর্ব বাজার বিওসি ঘাট এলাকার নিজ বাসা থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। উল্লেখ্য, আবু আসিফ আহমেদ আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। আশুগঞ্জ থানার অফিসার আজাদ রহমান জানান, গত ১৩ জানুয়ারি উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামে পুলিশের ওপর হামলার একটি মামলায় মুসা মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই মামলার এহাজারে ২০০ থেকে ৩০০ জন অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে। তদন্তে মুসা মিয়ার সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় ডিবি পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে থানায় হস্তান্তর করেছে।

স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদ বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমি বিজয়ী হব। পুরো এলাকায় দিন দিন আমার সমর্থন বাড়ছে। এ অবস্থায় গত রাতে আমার নির্বাচনের প্রধান প্রচারক মুসা মিয়াকে ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এ ছাড়া গত রাত থেকে আমার শ্যালক শাফায়াত সুমনকে (৩৮) খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শাফায়াত সুমন আমার নির্বাচন পরিচালনার প্রধান সমন্বয়কারী।’ সুমনকেও ডিবি পুলিশ তুলে নিতে পারে বলে তার ধারণা।

তবে সুমন নিখোঁজ থাকার ব্যাপারে পুলিশ কিছুই জানে না বলে আশুগঞ্জ থানার অফিসার আজাদ রহমান জানান।

সর্বশেষ খবর