সোমবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

সাইবার অপরাধের থাবা

মামলার ২৯ শতাংশ অনলাইন কেনাকাটায়, অপপ্রচার ২১ শতাংশ, পর্নোগ্রাফি ২০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্তে অসহায় নারী

আলী আজম

সাইবার অপরাধের থাবা

অষ্টম শ্রেণি পাস করা তানজিনা আক্তার ইভা ওরফে মেরি ওরফে মাহি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অর্ধনগ্ন ছবি ও ভিডিওর ফাঁদে ফেলে বিভিন্নজনকে আটকাতেন প্রেমের জালে। এরপর হাতিয়ে নিতেন মোটা অঙ্কের টাকা। তার মতো মাসুম বিল্লাহ ফারদিন ওরফে রাজু উল্লাহ ওরফে রাজু গাজীপুরের এক এমপির ছেলে পরিচয় দিতেন। এভাবে একের পর এক নারীর সঙ্গে প্রেম ও পরকীয়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। এই দুজনের মতো কর্মকান্ড সারা দেশেই ছড়িয়েছে। দিন দিন বহুমুখী এই সাইবার অপরাধ বেড়েই চলছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে ওই পরিস্থিতি কিছুটা অনুমান করা যায়।

তাদের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছর ডিবির সাইবারে আসা ১৭১টি মামলার ২৯ দশমিক ২৩ শতাংশ অনলাইনে কেনাকাটায়, ২১ দশমিক ৫ শতাংশ অপপ্রচারের, ২০ দশমিক ৪৬ শতাংশ পর্নোগ্রাফি মামলা ও ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মামলা। এর আগে ২০২১ সালে ডিবি সাইবারে ২০৬টি মামলা আসে। যার মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা ২৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ২০ দশমিক ৩৮ শতাংশ অপপ্রচারের, ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ অনলাইন কেনাকাটায়, ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল পর্নোগ্রাফি মামলা। ডিবি সাইবারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সচেতনতার অভাবে এসব অপরাধ বাড়ছে।

প্রতারক তানজিনা আক্তার ইভা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘ও লেভেল’ এবং ‘এ লেভেল’ পাস করে যুক্তরাজ্যের একটি আইটি ফার্মে কর্মরত রয়েছেন। টিকটক, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাটসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত পোস্ট দিতেন নিজের অর্ধনগ্ন ছবি ও ভিডিও। পরে টার্গেট ব্যক্তিকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ফেলতেন প্রেমের জালে। ধনাঢ্য হলে করে ফেলতেন বিয়ে। পরে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও ধারণ এবং অডিওর কথোপকথন রেকর্ড করে ব্ল্যাকমেলের মাধ্যমে হাতিয়ে নিতেন মোটা অঙ্কের টাকা। তার এ প্রণয়ে পড়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি।

বিয়ের ফাঁদে পড়েছেন কমপক্ষে ১০ জন। যাদের মধ্যে সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও রয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, ইভার সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন সম্প্রতি গ্রেফতার গাজীপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি রহমত আলীর ছেলে পরিচয় দিয়ে ৪০ নারীকে প্রেম-পরকীয়ার ফাঁদে ফেলা প্রতারক ফারদিন। দুজনে মিলে বিভিন্ন ফাঁদে ফেলে নিঃস্ব করতেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে। রিমান্ডে ফারদিনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই ১৫ জানুয়ারি ইভাকে গ্রেফতার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম উত্তর বিভাগ।

মাসুম বিল্লাহ ফারদিন ওরফে রাজু উল্লাহ ওরফে রাজু। গাজীপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি রহমত আলীর ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তার ৪ লাখেরও বেশি ফলোয়ার। এটি সত্য প্রমাণ করতে বিভিন্ন হাইপ্রোফাইল ব্যক্তির সঙ্গে ছবি তুলে নিয়মিত ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করতেন। আর এতেই একের পর এক নারীর সঙ্গে প্রেম ও পরকীয়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে তার প্রতারণাও। কিছুদিন প্রেমের সম্পর্ক না যেতেই বিভিন্ন বাহানায় হাতিয়ে নিতে থাকেন মোটা অঙ্কের টাকা। এভাবে কমপক্ষে ৪০ নারীকে প্রেম-পরকীয়ার ফাঁদে ফেলে হাতিয়েছেন কোটি টাকা। গত ১১ জানুয়ারি তাকেও গ্রেফতার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম উত্তর বিভাগ। জুনায়েদ রুহানী ওরফে রুবেল রানা ওরফে রুবেল রুহানী। নিজেকে ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দিয়ে ফেসবুকের মাধ্যমে অর্ধশত নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। পরে নানাভাবে হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। যারা টাকা দিতে রাজি হতো না, তাদের ভুয়া গ্রেফতারি পরোয়ানা (ওয়ারেন্ট) পাঠাতেন। স্বজন ও সহপাঠীদের কাছে কুৎসা রটানো, এমনকি ছবি সংবলিত বাজে পোস্টার লাগাতেও পিছপা হতো না রুহানী। ফেসবুক আইডিতে উল্লেখ করা পেশাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে রুহানীর ফাঁদে পা দেয় অর্ধশত নারী।

এসব ভুক্তভোগীর বেশির ভাগই উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণী। বেশির ভাগ মামলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও প্রচারের অভিযোগে করা। এ ছাড়া বিভিন্ন পর্নো সাইটে আপত্তিকর ভিডিও আপলোডের ঘটনাও রয়েছে। প্রেম, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের সুযোগে ধারণ করা আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ফেসবুক, ইউটিউব ও বিভিন্ন পর্নোসাইটে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা বেশি ঘটছে। এসব ঘটনায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা যতটা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি হচ্ছে সাধারণ ডায়েরি (জিডি)। কারণ ভুক্তভোগীরা সামাজিক ও পারিবারিক কারণে মামলা নিয়ে বেশি দূর এগোতে চান না।

এদিকে সাইবার অপরাধ দমনে পুলিশের বিশেষ ইউনিট ‘সাইবার পুলিশ ইউনিট’ গঠন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে পুলিশ সদর দফতর থেকে এই ইউনিট গঠনের প্রস্তাবটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। এ ইউনিটটি গঠন করার জন্য ২ হাজার ১২১ জনবলের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ইউনিটের প্রধান হবেন একজন ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তা। ইউনিটের হেড অফিস হবে ঢাকায়। তবে দেশের প্রতিটি জেলায় সাইবার ইউনিটের সাব অফিস থাকবে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) আদলে শিগগিরই এই ইউনিটের কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে সাইবার অপরাধ দমনে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগকে দুটি (উত্তরা ও দক্ষিণ) ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তাদের কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম উত্তর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ বলেন, সাইবার স্পেসে অপরিচিত কোনো আইডি থেকে পাঠানো কোনো লিংকে প্রবেশ না করা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরিচিত কোনো আইডির সঙ্গে বন্ধুত্ব না করা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যথাযথ সিকিউরিটি সেটিংস ব্যবহার করা, ম্যাসেঞ্জারে স্পর্শকাতর তথ্য, ছবি বা ভিডিও শেয়ার না করা। পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে আকর্ষণীয় ফেসবুক আইডি রিকোয়েস্ট গ্রহণ না করা অবৈধভাবে চাকরি, বদলি বা বিদেশ যাওয়ার জন্য টাকার লেনদেন না করা এবং বাইরের চাকচিক্য দেখে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব না করা। একটু সচেতন হলেই এসব সাইবার অপরাধ থেকে নিজেকে দূরে রাখা সম্ভব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর