মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাজার করতেই পকেট ফাঁকা

♦ নিত্যপণ্যের বাজারে দিন দিন অস্থিরতা বাড়ছেই ♦ ডিমের ডজন আবারও ১৫০ টাকা ♦ ব্রয়লার মুরগি ও রসুনের কেজি ছাড়িয়েছে ২০০ টাকা ♦ তেল, চিনি ডাল, সবজি মাছ-মাংসের বাজারও চড়া

মানিক মুনতাসির

বাজার করতেই পকেট ফাঁকা

ঘটনাপ্রবাহ-১। জামিল হোসেন। বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা। তাঁর সঙ্গে দেখা হয় রামপুরা বাজারে। তিনি বলেন, আগে সবচেয়ে বেশি পেরেশানি ছিল বাড়ি ভাড়া নিয়ে। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে খাবারের খরচ। জিনিসপত্রের দাম যে হারে বাড়ছে তাতে মাছ-মাংস ছেড়ে সবজি আর ডালভাত খাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো জিনিসের দাম বাড়ছে। বেতনের প্রায় অর্ধেকই চলে যায় বাড়ি ভাড়ায়। সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল- দুটোই বেড়েছে। এরপর দুই সন্তানের স্কুলের বেতন গত বছর ছিল ৫ হাজার, এখন ৭ হাজার। ছয় মাস আগে বাবা-মায়ের ওষুধের জন্য রাখতাম ৩ হাজার টাকা, এখন ৫ হাজার টাকা। যাতায়াত খরচের জন্য আলাদা রেখে দিতে হয় ৫ হাজার টাকা, যা আগে ৩ হাজার টাকায় চলা যেত। খাওয়াদাওয়া বাবদ যেখানে ৬-৭ হাজার টাকায় ভালোভাবে চলা যেত, সেখানে এখন ১০-১২ হাজার টাকায়ও চলা যায় না। সঞ্চয় বলতে কিছুই করতে পারি না।

তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো এক বেলা না খেয়ে থাকতে হবে। কারণ ঋণ করারও তো জায়গা নেই। এ ছাড়া ঋণ করলে তা শোধ-ই বা করব কীভাবে?

ঘটনাপ্রবাহ- : রোজিনা আক্তার। গৃহকর্মী। স্বামী সিএনজিচালক। তিনি বলেন, দুই বাড়িতে কাজ করে মাসে আয় করেন ৮ হাজার টাকা। স্বামীর আয় মাসে ৮-১০ হাজারের মতো। এক বছর আগে একটা ডিপিএস ছিল। নতুন বছরে তা ভেঙে করোনা মহামারির ঋণ পরিশোধ করেছেন। এখন আর কোনো সঞ্চয় নেই। আগে মাসে তিন-চার দিন মাছ-মুরগি খেতেন এখন তা দুই দিনে নামিয়ে এনেছেন। কোরবানি ঈদ ছাড়া গরুর মাংস কেনার সামর্থ্যই হয় না। আগে বাচ্চাদের ডিম খাওয়াতেন মাঝেমধ্যে এখন তা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে যা আয় করেন, ঘর ভাড়া আর ডালভাতের খরচ বাদ দিলে হাতে কোনো টাকাই থাকে না। এর পরও গ্রামে বৃদ্ধ মায়ের জন্য মাসে ২ হাজার টাকা পাঠাতে হয়। তিনি বলেন, মা গ্রামে ফিরে যেতে বলেছেন কিন্তু পারছেন না। কারণ নিজেদের কোনো জায়গাজমি নেই। কী করবেন গ্রামে গিয়ে। ফলে জীবনযাপনের খরচ মেটাতে কোনো হিসাবই যেন মেলাতে পারছেন না। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, মানুষ চরম অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। অবশ্য সারা বিশ্বই এখন একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।

এটাই চরম বাস্তবতা যে, করেনা মহামারির চেয়েও বর্তমান পরিস্থিতি অনেক বেশি অস্বস্তিকর। সে সময় মানুষের যতটা না ভোগান্তি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ভোগান্তিতে রয়েছে এখন। কেননা সে সময় দ্রব্যমূল্য খুব একটা বাড়েনি। অথচ গত বছর ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ছুতা দেখিয়ে দেশি ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির যে বহুমুখী প্রভাব রয়েছে, তার চিত্র ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের বাজারে। দেশের নিত্যপণ্যের বাজারে দিন দিন অস্থিরতা বাড়ছেই। ডিমের ডজন আবারও ১৫০ টাকা। ব্রয়লার মুরগি ২২০ টাকা ও রসুনের কেজি ছাড়িয়েছে ২০০ টাকা। তেল, চিনি, ডাল, সবজি, মাছ-মাংসের বাজারও চড়া। নেই কোনো মনিটরিং। ফলে সিন্ডিকেট চক্র ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছে কমাচ্ছে। গরুর মাংস তো একটা শ্রেণির মনুষ খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে। দেশি মুরগির দামও আকাশচুম্বী। কম দামি মাছ তেলাপিয়া, কই, শিং, মাগুর, পাঙ্গাশ, সরপুঁটি, নলা এগুলোও এখন বেশ দামি। ২২০ বা ২৫০ টাকার নিচে কোনো মাছই পাওয়া যায় না। দেশি গুঁড়া চিংড়ির দাম বাড়তে বাড়তে হাজার টাকার কাছাকাছি উঠে গেছে। চাল, চিনি, তেল, ডাল, আটা, ময়দা কোনোটার দাম বাড়েনি। বাজারে সস্তা বলতে রয়েছে আলু। যার কেজি ২০-২৫ টাকা। আসছে রমজানে জিনিসপত্রের দাম আরও কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা নিয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে অনেক আগেই। এখন কোনোরকমে দাম কামড়ে বেঁচে থাকার লড়াই করছে সাধারণ মানুষ।

এ ছাড়া পণ্যমূল্যের বাজারে নেই তেমন কোনো তদারকি। ফলে কারণে অকারণে দাম বাড়াতে তৎপর সিন্ডিকেট। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। সম্প্রতি বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের মূল্য। এতে বিদ্যুৎ, শিল্পসহ উৎপাদন খাতের খরচ বাড়বে। ফলে বিদ্যুতের দামও বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো পণ্যের দাম এক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। যেমন গত বছরের এই দিনে ২ কেজি আটার (প্যাকেট) দাম ছিল ৬৫-৭৫ টাকা। গতকাল তা বিক্রি হয়েছে ১৪০-১৫০ টাকায়। সব ধরনের একটি সুগন্ধি সাবানের দামও দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কাপড় ধোয়ার গুঁড়া সাবানের দামও বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। এতে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির জাঁতাকলে রীতিমতো পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

এদিকে শাকসবজিসহ সব ধরনের তরিতরকারি ও জিনিসপত্রের দাম এখনো বাড়তিই রয়েছে। মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র, খাদ্যপণ্য, গুঁড়া-বার সাবানসহ প্রসাধনীর দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ওষধুপত্রের বাজারেও এমন কোনো আইটেম নেই যার দাম বাড়েনি। এ ছাড়া আগামী মার্চ ও এপ্রিল জুড়ে আসছে রমজান। রোজা ও ঈদে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের খরচের ফর্দ অন্য সময়ের তুলনায় লম্বা হয়। ফলে সামনের দিনগুলোয় মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়ার আশঙ্কাই করছেন তারা। সরকারি ট্রেডিং সংস্থা টিসিবির হিসাবেই প্রতি কেজি আটার দাম এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। একই সময়ে ময়দার দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। এ সময়ে সয়াবিন তেলের দামও বেড়েছে অন্তত ২০ শতাংশ। জিরার দাম বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। দেশি রসুন ১৭২ শতাংশ, আদা ১২২ শতাংশ এবং দেশি শুকনা মরিচের দাম বেড়েছে ১৬৯ শতাংশ। চালের দামও বেড়েছে লাগামহীনভাবে। প্রতি ডজন ডিমের দাম ৯০ টাকা বেড়ে ১৫০ টাকায় উঠেছিল। সেটা মাঝে কিছু নামলেও এখন আবারও ১৫০ টাকায় উঠেছে। টিসিবির হিসাবে মসুর ডালের দামও বেড়েছে ৬২ শতাংশ। অথচ বলা যায়, এ সময়ের মধ্যে মানুষের আয় বাড়েনি এক টাকাও। বরং করোনা মহামারির পর অনেকের আয় উল্টো কমে গেছে। অনেকেই করোনা মহামারির সময় হারানো কাজ এখনো ফিরে পায়নি। এতে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে মানুষকে রীতিমতো নাক ও চোখের পানি এক করতে হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষ ভেতরে ভেতরে ফুঁসে আছে। প্রকাশ করতে পারছে না। নিম্ন আয়ের মানুষ তো ভয়াবহ রকমের কষ্টে আছে। তার চেয়ে সংকটে পড়েছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরা। কারণ তারা কাউকে বলতেও পারছে না। আবার সইতেও পারছে না। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের কর্মসূচি খুবই সামান্য। শুধু রেশন আর ফ্যামিলি কার্ড ছাড়া তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। তবে রেশন বা ফ্যামিলি কার্ডের চেয়ে কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা। এজন্য বাজারে কঠোর তদারকি এবং গরিব মানুষের জন্য রেশনব্যবস্থার প্রসার ঘটানো জরুরি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এসব প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়- পরিবহন, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ বেশির ভাগ খাদ্যবহির্ভূত সূচকে মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়েছে।

এ খাতগুলোয় সরকারের বিনিয়োগ খুবই কম। অথচ রাষ্ট্রের মূলনীতি অনুযায়ী মানুষের সুস্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে এ খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হওয়াটা খুবই হাতাশাজনক বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর