শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

গোপনে দেশে ক্যাসিনো সাঈদ আধিপত্য পুনরুদ্ধারে মরিয়া

♦ ফিরেছেন বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের পদে ♦ পুলিশ বলছে তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা নেই

মাহবুব মমতাজী

গোপনে দেশে ক্যাসিনো সাঈদ আধিপত্য পুনরুদ্ধারে মরিয়া

গোপনে দেশে ফিরেছেন, তবে এখন রাজধানীতে প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বহিষ্কৃত কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক ওরফে ক্যাসিনো সাঈদ। মরিয়া হয়ে উঠেছেন মতিঝিলে আধিপত্য পুনরুদ্ধার করতে। তিন দিন আগে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের পদে ফিরেছেন। তার দেশের ফেরার খবরটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার দেওয়ায় মতিঝিলে স্থানীয় মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি আহম্মেদ ইসলাম পুতুলের ওপর হামলা করে ক্যাসিনো সাঈদের ক্যাডার বাহিনী।

অথচ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের মামলা করেছে। দুই সংস্থাই বলছে, ক্যাসিনো সাঈদ পলাতক। অবশ্য মতিঝিল থানা পুলিশ বলছে, ক্যাসিনো সাঈদ আছেন, কিন্তু তার নামে তাদের থানায় কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা নেই।

ঢাকার অভিজাত ক্লাব-হোটেলগুলোতে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার অন্যতম হোতা ক্যাসিনো সাঈদ। দেশে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় তার সঙ্গী সবাই ধরা পড়েন। তাদের বেশির ভাগই এখন কারাগারে। কিন্তু তিনি দেশে ফিরেই বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তার এই ফেরাতে চাঙা হয়ে মারমুখী আচরণ শুরু করেছে তার ক্যাডার বাহিনী। সম্প্রতি অন্তত চার ব্যক্তি সাঈদের হামলার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ১৩ ফেব্রুয়ারি মতিঝিল থানায় একজন মামলা করেন।

মামলার এজাহারে মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি আহম্মেদ ইসলাম পুতুল অভিযোগ করেন, সাঈদের একটি সংবাদ ফেসবুকে শেয়ার দেওয়ায় তার ওপর হামলা চালানো হয়। এতে তিনিসহ তিনজন আহত হন। এ সময় তাদের কাছে থাকা ৮৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়। এ সময় হত্যার হুমকি দেন হামলাকারীরা। মামলায় বশির, মোস্তফা মিয়া, শফিকুল ইসলাম ইকবাল, মনজু, মহসিন মির্জা, আলম, জয়, হানিফ ভূঁইয়া ও মনিরের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ২০-২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।

ওই ব্যক্তি জানান, মামলার পর বশির ও মোস্তফা মিয়া নামে দুই হামলাকারীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তারা জামিনে বেরিয়ে এসে তাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে।

জানা গেছে, মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি আহম্মেদ ইসলাম পুতুল এখন মুগদা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ছাড়া সাঈদের লোকজন মারধর করেছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রহমত আলী ও তার স্ত্রী মর্জিনাকে। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোজাম্মেল হককেও লাঞ্ছিত করেছেন তারা।

সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ২৮ নভেম্বর সাড়ে ৪ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ক্যাসিনো সাঈদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান সরকার তাদের ঢাকা-১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি করেন।

দুদক কমিশনার জহুরুল হক এ প্রতিবেদককে বলেন, ওই ব্যক্তির নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে কি না জানা নেই। তিনি দেশে ফিরেছেন কি না তাও জানি না। দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক বলেন, ক্যাসিনো সাঈদকে গ্রেফতারের কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছিল কি না তা জানা নেই। ২০১৫ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর মতিঝিলের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা চালু করেছিলেন ক্যাসিনো সাঈদ। এ ছাড়া মতিঝিল এলাকার আরও চারটি ক্লাবের ক্যাসিনো ব্যবসাও তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয়। ওই অভিযানে ১৩ জন গ্রেফতার হন। তবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ক্যাসিনো সাঈদ। গত তিন বছর তিনি দুবাই, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করেন।

সিআইডি সূত্র জানায়, ক্যাসিনো সাঈদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ২০২১ সালের মে মাসে মতিঝিল থানায় মামলা করে পুলিশ। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেন সিআইডির এসআই জাহিদ। তিনি বদলি হয়ে যাওয়ায় মামলাটির তদন্তভার পান সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক মাধবী। কয়েকদিন পর তার শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। দুই মাস আগে মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয়েছে পুলিশ পরিদর্শক রাকিবকে।

পুলিশ পরিদর্শক মাধবী এ প্রতিবেদককে বলেন, সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়া থেকে ক্যাসিনো সাঈদের মামলাটির এমএলআর দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তথ্য না আসায় তদন্ত শেষ করা যায়নি। আর এ মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতারের অনুমতি থাকে। এর জন্য আদালত থেকে আলাদাভাবে পরোয়ানা জারির কোনো প্রয়োজন হয় না।

চাঁদাবাজি এবং সংঘবদ্ধ অপরাধের (ক্যাসিনো ও জুয়া খেলায় পরিচালনা) মাধ্যমে ২৪ কোটি ৯৯ লাখ ৮২ হাজার ৩৫৯ টাকা উপার্জন, ৫১ হাজার সিঙ্গাপুর ডলার ও ৬৮ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বিদেশে পাচারের অভিযোগে সিআইডির এসআই সোহানুর রহমান ২০২১ সালের ৩০ মে ক্যাসিনো সাঈদের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মামলা করেন।

জানা গেছে, ৩০ জানুয়ারি সিআইডি ও দুদকের তিন মামলায় আগাম জামিনের জন্য হাই কোর্টে আবেদন করেন ক্যাসিনো সাঈদ। ওইদিন আদালতে আসামি পক্ষে ছিলেন আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা এবং রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। পরে আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, তিন মামলায় সাবেক এ কাউন্সিলর আগাম জামিন চেয়েছিলেন। আদালত তার আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। আর দুই সপ্তাহের মধ্যে তাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন। ক্যাসিনো সাঈদের দেশে ফিরে আসার বিষয়ে মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন, তাকে গ্রেফতারে আমাদের কাছে কোনো পরোয়ানা নেই। একটি সূত্র জানায়, চলতি মাসের শুরুতে ওমান থেকে কলকাতা আসেন সাঈদ। বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে দেশে ঢুকে অতিগোপনে পরপর তিনটি মামলায় জামিন নেন। জামিন পেয়েই মতিঝিল ও আরামবাগ এলাকার হারানো আধিপত্য পুনরুদ্ধারে সব বন্দোবস্ত করেই ১৪ ফেব্রুয়ারি হকি ফেডারেশনের সভায় যোগ দেন। এরপরই সব মহলে হইচই পড়ে যায়।

সর্বশেষ খবর