সুস্বাস্থ্যের জন্য যারা শরীরচর্চা, হাঁটাহাঁটি করেন, তাদের বড় অংশই সকালের সময়টাকে বেঁছে নেন। ভোরে রাজধানীর পার্কগুলোতে অসংখ্য মানুষকে শরীরচর্চা করতে দেখা যায়। তবে তথ্য বলছে, দূষণের কারণে আর প্রাতঃভ্রমণের উপযোগী নেই রাজধানী ঢাকার বাতাস। দিনের মধ্যে সকালেই সবচেয়ে বিষাক্ত থাকে রাজধানী। ঢাকায় ২৪ ঘণ্টায় বায়ুদূষণের যে গড়, তার চেয়ে সকালে প্রায় ৭৫ শতাংশ বেশি দূষিত থাকছে বাতাস। মাঝেমধ্যে মধ্যরাতে দূষণমাত্রা চূড়ায় উঠলেও গত চার মাসে কখনোই স্বাস্থ্যকর ছিল না সকালের বাতাস। তবে দূষণমাত্রা কিছুটা কমছে বিকালে। এ কারণে শুষ্ক মৌসুমে সকালের পরিবর্তে বিকালে শরীরচর্চার পরামর্শ দিয়েছেন বায়ুমান গবেষকরা। বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা আইকিউ এয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত নভেম্বর থেকেই বায়ুদূষণে বিশ্বের মধ্যে শীর্ষ পাঁচ শহরের মধ্যে থাকছে ঢাকার নাম। মাঝে মধ্যেই উঠে আসছে এক নম্বরে। আর দিনের মধ্যে বাতাস সবচেয়ে বেশি দূষিত থাকছে সকালে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় প্রতি ঘনমিটার বাতাসে স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি পিএম-২.৫ (অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা) এর সর্বোচ্চ উপস্থিতি হবে গড়ে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। আইকিউ এয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গতকাল (৫ মার্চ) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৮ ঘণ্টায় বায়ুমান সূচকে (একিউআই) ঢাকার গড় স্কোর ছিল ১৯১। প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম ২.৫ ছিল ১৩২.৮ মাইক্রোগ্রাম, যা অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই ১৮ ঘণ্টার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষণমাত্রা রেকর্ড করা হয় সকাল ৮টায়। এ সময় ঢাকার একিউআই স্কোর ছিল ৩২২। প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পিএম ২.৫ ছিল ২৭১.৫ মাইক্রোগ্রাম, যা বিপজ্জনক। সন্ধ্যা ৬টায় একিউআই স্কোর কমে হয় ১৫২, যা ১৮ ঘণ্টার মধ্যে সর্বনিম্ন। ৪ মার্চ ২৪ ঘণ্টায় বায়ুমান সূচকে ঢাকার স্কোর ছিল ১৯৭, সর্বোচ্চ স্কোর ছিল সকাল ৭টায় ৩০৩ ও সর্বনিম্ন স্কোর ছিল বিকাল ৪টায় ১৩৮। ৩ মার্চ সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ভোর ৪টায় ২৭০, সর্বনিম্ন ছিল বিকাল ৫টায় ১৫২। একই চিত্র দেখা গেছে আগের মাসেও। ২৬ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ স্কোর ছিল সকাল ৮টায় ১৯৩, সর্বনিম্ন স্কোর ছিল বিকাল ৪টায় ১৪২। ২৭ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ স্কোর ছিল সকাল ৬টায় ২৯৪, সর্বনিম্ন স্কোর ছিল বিকাল ৫টায় ১১৯। দুই মাসের প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে ভোর ৪টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত সবচেয়ে দূষিত থাকছে ঢাকার বাতাস। বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দূষণ কিছুটা কমলেও তা থাকছে অস্বাস্থ্যকর। এ ছাড়া গত নভেম্বর থেকে চার মাসে একদিনও স্বাস্থ্যকর ছিল না রাজধানীর ভোরের আবহাওয়া।
বায়ুমান সূচকে স্কোর শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলে তাকে ভালো বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ৫১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সহনশীল, ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর, ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১ থেকে দুর্যোগপূর্ণ বা বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হয়। এই অবস্থা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁঁকি তৈরি করে। ফলে শিশু, প্রবীণ এবং অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভিতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। ঘরে বাতাস বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র চালানোর পাশাপাশি বাইরে শরীর চর্চাও সীমিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়। আর গত চার মাস ধরে এই পরামর্শ ঢাকাবাসীকে দিয়ে আসছে আইকিউ এয়ার।
এ ব্যাপারে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজধানী ঢাকার ৬০ ভাগ বায়ুদূষণ হয় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাসে। আমরা সাত বছরের বায়ুমানের তথ্য বিশ্লেষণ করে মাস দুই আগে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। তাতে দেখেছি ঢাকায় মূলত রাত ২টা-৩টা ও সকাল ৬টা-৮টা বাতাস সবচেয়ে দূষিত হয়ে উঠছে। বিকাল ৪টার দিকে কমে আসে। শুষ্ক মৌসুমে এই সমস্যাটা হয়। একদিকে সারা দিনের দূষণ উপাদান কুয়াশায় ভিজে ভোরে নিচে নেমে আসে। অন্যদিকে তাপ বাড়লে বায়ু উত্তপ্ত হয়ে হালকা হয়ে যায়। তখন দূষণ উপাদান উপরের দিকে উঠে যায়। এ জন্য সূর্যের তাপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দূষণ কমে। বিষয়টা চিকিৎসকদের জানানোর জন্য আমাদের প্রতিবেদনে পরামর্শ দিয়েছিলাম, যাতে তারা রোগীদের সকালের বদলে বিকালে শরীরচর্চার পরামর্শ দিতে পারেন। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সকালে শরীরচর্চা, হাঁটাহাঁটিতে সমস্যা নেই। তবে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এটা উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি। একদম জরুরি যাদের, তারা ঘরের ভিতরে শরীরচর্চা করতে পারেন। তিনি বলেন, সকালে দূষণের এই সমস্যাটা ঢাকাতেই বেশি। এর কারণগুলোও বের করেছি। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তরিক হলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।