সোমবার, ২০ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

পাঠদান নয়, রাজনীতিতেই মন

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের দলাদলি বিঘ্নিত শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষক রাজনীতির কারণেও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, গ্রুপিং, আন্দোলন-পাল্টা আন্দোলনে জড়াতেও দেখা যায় শিক্ষকে-শিক্ষকে। একপক্ষের বিপক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ তুলতেও পিছপা হন না অন্য শিক্ষকরা। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে পরীক্ষা, তৈরি হচ্ছে সেশনজট। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান আর গবেষণা নয় বরং শুধু রাজনীতিতেই মন দিতে দেখা যায় শিক্ষকদের। সার্বিকভাবে শিক্ষকদের এমন রাজনীতিতে নষ্ট হচ্ছে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ।

রাজনীতি সমর্থন করতে গিয়ে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও দলীয় ব্যানারের রাজনীতির প্রচারণায় জড়ান, যা নিয়ে তৈরি হয় তুমুল সমালোচনার। শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষকরা রাজনীতি সচেতন থাকবেন, রাজনীতিতে সম্পৃক্তও হতে পারেন। কিন্তু পাঠদান আর গবেষণা বাদ দিয়ে রাজনীতিই যেন মুখ্য না হয়। অভিযোগ রয়েছে- রাজনীতির স্বার্থে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনকেও ব্যবহার করছেন শিক্ষকরা।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদকরা জানান, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আবদুস সালামের বেশ কয়েকটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হওয়ার ঘটনায় শিক্ষক রাজনীতি এখন তুঙ্গে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। অডিও ফাঁসের ঘটনায় ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি’ ও প্রগতিশীল শিক্ষকদের সংগঠন ‘শাপলা ফোরাম’ পৃথক সভা করে লিখিতভাবে উপাচার্যের বক্তব্য জানতে চেয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারের বিভিন্ন দফতরে চিঠি পাঠানোরও ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষক নেতারা।

জানা গেছে, উপাচার্যের নানা অনিয়মের ঘটনায় ইতোমধ্যে অভিযোগ জমা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে। বিশ্ববিদ্যালয় শাপলা ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, উপাচার্যের বেশ কয়েকটি অডিও ছড়িয়ে পড়ায় শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয়েছে। অডিও রেকর্ডে উপাচার্য এ বিশ্ববিদ্যালয়কে জাহান্নামের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ, প্রশ্ন ফাঁস করে প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়টিও তার অডিও রেকর্ডে উঠে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য নিয়েও নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন এ উপাচার্য। তাই আমরা তার কাছে এই রেকর্ড নিয়ে লিখিতভাবে বক্তব্য জানতে চেয়েছি। উপাচার্যের ফাঁস হওয়া কথোপকথনের তথ্যে শিক্ষক সমাজের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণœ হয়েছে। যতদ্রুত সম্ভব সরকারের যথাযথ পদক্ষেপে এই অস্বস্তিকর পরিবেশের অবসান হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।

অডিও ফাঁসের ঘটনায় সৃষ্ট শিক্ষক অসন্তোষের ব্যাপারে উপাচার্য ড. শেখ আবদুস সালামের ফোন বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য জানতে পারেননি প্রতিবেদক। গত সন্ধ্যায় দফায় দফায় ফোন করলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে এর আগে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যে অডিও ছড়িয়েছে, এগুলো তাঁর ‘কণ্ঠসদৃশ’, সেগুলো সঠিক নয়। উপাচার্যের অডিও ফাঁসের ঘটনায় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মীরা দফায় দফায় উপাচার্যের দফতরে তালা দিয়েছেন যা শিক্ষকদের অসন্তোষে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়েও তৈরি হয়েছে অস্থিতিশীল পরিবেশ। প্রভাব পড়েছে নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষাতেও। এ ছাড়া উপাচার্যের অডিও ফাঁসের বক্তব্যে শিক্ষকদের মর্যাদা চরমভাবে ক্ষুণœ হয়েছে উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬ জন শিক্ষক লিখিতভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিধি ছোট হলেও এ ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের দলাদলি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কম নয়। ক্যাম্পাসে বর্তমানে শিক্ষকদের আলাদা আলাদা চারটি সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা প্রধান দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে রাজনীতি করছে। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নীল দল ও বিএনপি সমর্থিত সাদা দলেই শিক্ষকদের বড় দুটি অংশ রয়েছে। এ ছাড়াও নীল দলের অভ্যন্তরীণ কোনো দলে বিভক্ত হয়ে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে নীল দলের রাজনীতি করছে শিক্ষকেরা। এ ছাড়াও কিছুদিন পূর্বে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের নতুন সংগঠন ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনতা শিক্ষক সমাজ’ নামে আরেকটি দলের আত্মপ্রকাশ করে। শিক্ষকদের এসব অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং ক্ষমতা লাভের আশায় দিনদিন অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে ক্যাম্পাসের নিয়মিত শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। শিক্ষক রাজনীতির বলির পাঠা হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক নেতারা একাধিক পদে থাকার জন্য নিয়মিত পাঠদান কার্যক্রমে অংশ নিতে পারছেন না। বিভিন্ন সভা, সেমিনার, রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে সময় দিতে গিয়ে নিজ বিভাগের কাজগুলো শেষ করতে পারে না এই শিক্ষকরা। এ ছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের চলমান কাজ থমকে আছে শিক্ষকদের এসব ভূ-অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কোন্দলে। শিক্ষক নেতাদের পাঠদানে অবহেলা বেড়ে চলছে দিনের পর দিন। শিক্ষক রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও। শিক্ষকদের রাজনীতির কারণে বিঘিœত হচ্ছে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যানেল ভিত্তিক শিক্ষক রাজনীতিতে আওয়ামী শিক্ষকদের দুটি গ্রুপ ও বিএনপি-জামাতপন্থি শিক্ষকদের দুটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। মতাদর্শ সরাসরি প্রকাশ করে শিক্ষক রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার সুযোগ না থাকলেও অন্তর্কোন্দলের জেরে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তচিন্তা, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধ শব্দ ব্যবহার করে শিক্ষক রাজনীতিতে অংশ নিয়ে আসছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তবে শিক্ষক রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার কারণে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে ক্লাস-পরীক্ষা ও খাতা মূল্যায়নে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সময়ে বিশৃঙ্খলার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল শিক্ষক রাজনীতি। এসব শিক্ষকদের অধিকাংশই ঠিক সময়ে ক্লাস নেন না। কোর্স ও ক্রেডিট অনুসারে নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্লাস নেওয়ার কথা থাকলেও ব্যস্ততার কারণে স্বল্পসংখ্যক ক্লাস নিয়ে কোর্স শেষ করেন এসব শিক্ষক। এতে সেশনজটেরও সৃষ্টি হয়। বিভাগে শিক্ষকদের অন্তর্কোন্দলের কারণে শিক্ষার্থীরা ফলাফলে যথাযথ মূল্যায়ন পান না।

অভিযোগ রয়েছে- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান দ্বন্দ্ব এবং সমালোচনার মূল কেন্দ্রে রয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। দায়িত্ব পাওয়ার তিন বছরেও সিন্ডিকেটে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচন না দিতে পারা, একাধিক নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ, ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থতাসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। তবে গত ১২ ও ১৩ মার্চ প্রক্টরসহ প্রশাসনের ২৩ পদের ১৯ জন শিক্ষক পদত্যাগ করেন। যাদের উপাচার্য ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ উল্লেখ করেন। ভাগবাঁটোয়ারা, লেনদেন কিংবা স্বার্থের দ্বন্দ্বে তাঁরা পদত্যাগ করেন বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে উপাচার্য ও প্রক্টর পরস্পরবিরোধী মন্তব্য দিয়েছেন।

শিক্ষক রাজনীতিতে অতিরিক্ত সংশ্লিষ্টতার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে পাঠদান কার্যক্রমে অনীহার অভিযোগ আছে। সেমিস্টারের নির্ধারিত ক্লাস গ্রহণে অনীহা, সময়মতো পরীক্ষা খাতা না দেখা, গবেষণা-শিক্ষার্থীদের সময় না দেওয়াসহ আরও বেশকিছু অভিযোগ আছে। শিক্ষক রাজনীতিতে অতিরিক্ত সক্রিয় থাকার কারণে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের প্রভাবশালী কয়েকজন শিক্ষক নির্ধারিত ক্লাসের চেয়ে কম ক্লাস নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষকদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও রাজনীতিতে ধুঁকছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এসব দ্বন্দ্বের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয় শিক্ষার্থীরা। স্বার্থসিদ্ধির জন্য শিক্ষকেরা একে অন্যের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের লেলিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এতে শেষমেশ বলির পাঁঠা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাক্সিক্ষত শিক্ষা ও গবেষণা ব্যাহত হচ্ছে। একই সঙ্গে কাক্সিক্ষত মানব সম্পদ তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহানের আমলে শিক্ষকদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব তুঙ্গে ছিল। যার রেশ এখনো বহন করছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। নিয়োগ নীতিমালা শিথিল করে স্বজনদের চাকরি দেওয়াকে কেন্দ্র করেই এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। ফলে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিক্ষকদের আদর্শিক অবস্থান থাকবে। তারা রাজনীতি সচেতন হবেন এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু ইদানীং শিক্ষকদের রাজনীতিতে বেশি জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। এর কারণে পাঠদানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিক্ষকরা রাজনীতিতেও সম্পৃক্ত হতে পারেন কিন্তু এরও একটি পর্যায় থাকতে হবে, এর জন্য যেন শিক্ষার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল লক্ষ্য করা যায়, এটি কাম্য নয়। পাঠদানে অবহেলা করে, গবেষণা বাদ দিয়ে কেউ শুধু রাজনীতি করবেন এটি মেনে নেওয়া যায় না। শিক্ষকরা রাজনীতি সচেতন হয়ে দেশের জন্য কাজ করবেন। কিন্তু রাজনীতি করতে গিয়ে তাদের পাঠদান, গবেষণা গৌণ হয়ে যায়- এসব কাম্য নয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর