সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

চাচা-ভাতিজাকে নিয়ে যত আলোচনা বরিশালে

রাহাত খান, বরিশাল

চাচা-ভাতিজাকে নিয়ে যত আলোচনা বরিশালে

বরিশাল সিটিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়েছে। বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে পাল্টে বিসিসি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন তার চাচা মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়ের খোকন সেরনিয়াবাত। মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর এখন নগরময় আলোচনা চলছে চাচা খোকন সেরনিয়াবাত আর ভাতিজা সাদিক আবদুল্লাহকে নিয়ে। চায়ের দোকানে, অফিস, ব্যাংক-বীমা, বাসাবাড়িসহ যে কোনো আড্ডায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। দেশের বিভিন্ন স্থানের কৌতূহলী বাসিন্দারাও ফোন করে সাদিক আবদুল্লাহর বাদ পড়ার কারণ খুঁজছেন। তার বাদ পড়া আর খোকন সেরনিয়াবাতের মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন নগরীর সাধারণ বাসিন্দারা।

৩ এপ্রিল বিসিসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই আলোচনায় আসেন ১৫ আগস্ট কালোরাতে ঘাতক দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়ের খোকন সেরনিয়াবাত, যিনি বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন আমেনা বেগমের ছোট ছেলে, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপির ছোট ভাই এবং বর্তমান মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সাদিক আবদুল্লাহর চাচা খোকন সেরনিয়াবাত। মনোনয়নপত্র কেনার পর থেকেই আলোচনা ছিল বরিশাল সিটিতে কে পাচ্ছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শনিবার বরিশাল সিটিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয় আবুল খায়ের খোকন সেরনিয়াবাতকে। এতে বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারীরা হতাশায় পতিত হলেও দলের মধ্যকার প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীদের মাঝে বাঁধভাঙা উল্লাস দেখা গেছে। শনিবার বিকালে এবং সন্ধ্যার পর নগরীতে আনন্দ মিছিল করেন বিসিসির সাদিকবিরোধী কাউন্সিলররা। মনোনয়ন নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষে উচ্ছ্বাস আর হতাশা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন নগরবাসী।

বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক ছাত্রদল কর্মী নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘বর্তমান মেয়র মানুষের ঘাড়ে উঠে বসেছেন। যা ইচ্ছা তা-ই করছেন। একটা প্ল্যান পেতে মাসের পর মাস ঘুরতে হয়েছে। ছোটখাটো একটা কাজও মেয়রের নলেজ ছাড়া হয় না। সব কাজে তিনি হস্তক্ষেপ করেন। বিসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওএসডি আর বরখাস্ত করে ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছেন।’ এখানে মনোনয়ন পরিবর্তন করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান সাবেক এই ছাত্রদল কর্মী। সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, নিয়মিত কর্মচারীদের বসিয়ে রেখে মাস্টাররোল কর্মচারী দিয়ে সিটি করপোরেশন পরিচালনা করেছেন মেয়র। সর্বত্র প্রাধান্য দিয়েছেন মাস্টাররোল কর্মচারী ছাত্রলীগ নেতাদের। এ নিয়ে ক্ষোভের শেষ নেই কর্মচারীদের মধ্যে।

মহানগর আওয়ামী লীগের পদবিধারী এক নেতা বলেন, সাদিক আবদুল্লাহ নিজের বিপদ নিজেই ডেকে এনেছেন। শুরুর দিকে হোল্ডিং ট্যাক্স অস্বাভাবিক বাড়িয়ে নগরবাসীকে চাপে ফেলেছেন। সরকারি দফতরেও শতভাগ হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধি করে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন তিনি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নিরব হোসেন টুটুলের (শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক) আবির্ভাব এবং মেয়রের সব কাজে টুটুল-নির্ভরতার কারণে তার কাছের অনেকেই নিভৃতে চলে গেছেন। সাদিককে সামনে ফেলে নাজিরের পোলের এক সময়ের বিএনপি ক্যাডার মাদক ব্যবসায়ী টুটুল কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের মালিক হয়েছেন বলে আক্ষেপ করেছেন আওয়ামী লীগের ত্যাগী অনেকে। তাদের দাবি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শিক্ষিত প্রজ্ঞাবান মানুষদের পাশ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন মেয়র সাদিক। ফলে তার সঙ্গে চলাফেরা করছেন কিছু অর্ধশিক্ষিত ও মূর্খ, যারা তাকে ভুলপথে পরিচালিত করার চেষ্টা করতেন বলে অনুযোগ করেন তারা।

আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির এক দায়িত্বশীল নেতা বলেন, সাদিক আবদুল্লাহ মেয়র হয়ে মানুষের সঙ্গে ব্যবহারটা ঠিকমতো করেননি। মানুষকে সময় দেননি। মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছেন। প্রতিদিন সকালে তার বাড়িতে, অফিসে, এমনকি দলীয় কার্যালয়ে সাধারণ দর্শনার্থীদের সাক্ষাৎ দেওয়া খুব জরুরি ছিল। তার সবচেয়ে বড় সমস্যা তিনি ফোন ধরতেন না। বড় নেতা, এমপি-মন্ত্রীদের ফোনও তিনি ধরেননি। অপ্রয়োজনীয় ফেসবুক লাইভ করে অসংলগ্ন অনেক কথাবার্তা বলে নিজেকে হেয় করেছেন মেয়র সাদিক। এসব বিষয়ে সতর্ক হলে তার ভালো মেয়র হওয়ার সুযোগ ছিল। রাজশাহীতে শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছেলে খায়রুজ্জামান লিটনকে আবারও মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। সাদিকও তো রব সেরনিয়াবাতের নাতি। তিনি মনোনয়ন না পাওয়ায় কোনো কোনো মহল উচ্ছ্বাস করেছে। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। এ বিষয়গুলো পীড়া দেয়। সাদিক বিচক্ষণ হলে আনপ্যারালাল ও পপুলার লিডার হওয়ার সুযোগ ছিল বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগের ওই কেন্দ্রীয় নেতা। একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের সব সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু সুন্দর করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সিটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে জাতীয় নির্বাচনে। তাই প্রধানমন্ত্রী সব সিটিতে ভদ্র ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছেন। সরকার সুষ্ঠু ভোট করার চেষ্টা করে বরিশালে সাদিককে মনোনয়ন দিলে সবকিছু ভ-ুল হয়ে যেত। এ কারণে একজন সাদাসিধে ভদ্র মানুষকে মনোনয়ন দিয়েছেন সুষ্ঠু ভোট করার জন্য। এটা প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণতা বলে মন্তব্য তার। এদিকে এবার সাদিকের মনোনয়ন না পাওয়া তার জন্য একটা বড় শিক্ষা বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের একজন নেতা। তার মতে, এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে সাদিককে। মেয়র হিসেবে তার কী কী ভুল ছিল তা উপলব্ধি করতে হবে। এগুলো শোধরাতে পারলে আগামীতে আবারও ভালো কিছু হওয়ার সুযোগ রয়েছে তার।

সর্বশেষ খবর