শনিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিদেশি ফল দেশের মাটিতে

বাণিজ্যিক আবাদে বিপুল সম্ভাবনা দেখছে কৃষি বিভাগ

শামীম আহমেদ

বিদেশি ফল দেশের মাটিতে

৭-৮ বছর আগেও স্ট্রবেরি, ড্রাগন ফল ছিল বড় বড় সুপার শপের শৌখিন ফল। প্লেনে বা জাহাজে চড়ে আসত বিদেশ থেকে। ধনীদের বাজারের থলেতে উঠত চড়া মূল্যের বিনিময়ে। বর্তমানে ফুটপাতেই ঝুড়িতে বিক্রি হচ্ছে এসব ফল। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে দেশে। কমে এসেছে দাম। শুধু ড্রাগন বা স্ট্রবেরি নয়, দেশের মাটিতে ফলছে মাল্টা, কমলা, আঙ্গুর, অ্যাভোকাডো, রকমেলন, পার্সিমন, রাম্বুটান, চেরি, থাই সফেদা, লংগান, টক আতা, আলুবোখারা, ব্রেড ফ্রুট, নাশপাতি, জাবটিকাবা, সুইট লেমন, থাই পেয়ারা, থাই বারোমাসি আম, থাই মিষ্টি তেঁতুল, থাই কুল, থাই পেঁপে, মালবেরি, ত্বিন, গোল্ডেন ক্রাউন (হলুদ তরমুজ)-সহ অর্ধ শতাধিক বিদেশি ফল। হচ্ছে আবহাওয়া সহনশীল উন্নত জাত উন্মোচনে গবেষণা। সব বিদেশি ফলের ফলন বাংলাদেশের মাটিতে আশানুরূপ না হলেও অন্তত ১০-১৫টি ফল বাণিজ্যিক আবাদে বিপুল সম্ভাবনা দেখছে কৃষি বিভাগ।

ঝিনাইদহের মহেশপুরের রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে কমলার চাষ শুরু করেছিলেন। বর্তমানে সারা দেশে কমলার বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। বাজার সয়লাব দেশি কমলায়। মাল্টারও বাম্পার ফলন হচ্ছে পাহাড়ে। নওগাঁর সাপাহার উপজেলার কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানা চার বছর আগে তার খামারে অন্যান্য ফলের সঙ্গে ৫০টি মালবেরি চারা লাগান। বর্তমানে তার বাগান কাঁচা-পাকা মালবেরিতে ভরে গেছে। তার থেকে চারা নিয়ে এলাকার অনেকেই লাগিয়েছেন। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর আসলেই জাপানের জাতীয় ফল রঙিন পার্সিমনে দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে নাটোরের মডার্ন হর্টিকালচার সেন্টার। বাগানের মালিক এস এম কামরুজ্জামান ২৫টি জাতের পার্সিমন লাগিয়েছেন। তার থেকে চারা নিয়ে অনেকেই ফলগাছটি লাগাচ্ছেন। ফলটির বাণিজ্যিক আবাদ শুরু না হলেও স্ট্রবেরি, রকমেলন, ড্রাগন ফল চাষ করে স্বাবলম্বীও হয়েছেন অনেকে। বাড়ির ছাদেও হচ্ছে ফলগুলো। বর্তমানে দেশে ড্রাগন ফলের চাহিদার ৩৫ শতাংশই পূরণ হচ্ছে দেশি উৎপাদনে। চাহিদার ৭০-৮০ শতাংশ পূরণ হচ্ছে থাই পেয়ারায়। সারা বছর পাওয়া যাচ্ছে হলুদ বা সবুজ ছোট তরমুজ। আমদানি করা ফলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ১৫-২০ শতাংশ বাজার দখল করে নিয়েছে এসব ফল। কমে এসেছে দামও। বারো মাস মিলছে নানা রঙের রসালো ফল। উৎপাদনও বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৩৮৯ মেট্রিক টন স্ট্রবেরি ও ৮ হাজার ৬৫৯ মেট্রিক টন ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে স্ট্রবেরি ৭৮৯ মেট্রিক টন ও ড্রাগন ফল উৎপাদন হয়েছে ১৩ হাজার ৮৭২ মেট্রিক টন।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) উদ্যান গবেষণা কেন্দ্রের ফল বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বাবুল চন্দ্র সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা মে থেকে আগস্টের মধ্যে ৫৪ ভাগ ফল পেয়ে যাই। তার মধ্যে শুধু আম, কলা ও কাঁঠালই ৬০ ভাগ। বাকি আট মাস শুধু পেয়ারা, পেঁপে ও কলা ছাড়া অন্যান্য ফল তেমন পাই না। এতে পুষ্টির অসম বণ্টন হচ্ছে। সারা বছর ফল পেতে আমরা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ফলের জাত অবমুক্ত করছি। মাল্টা ও কমলা বিদেশি ফল। এটা এখন দেশে প্রচুর হচ্ছে। তবে অনেকে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বিদেশি ফলের বীজ এনে গাছ লাগাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে ফল হচ্ছে না। এ ছাড়া এতে নানা রোগ-ব্যাধি, পোকা-মাকড় দেশে ঢুকে যেতে পারে। তাই আগে গবেষণাগারে ট্রায়াল দিতে হবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই মাঠ পর্যায়ে নিতে হবে। আবহাওয়া ও তাপমাত্রার কারণে সব বিদেশি ফল এখানে হবে না। গাছ হলেও ফল ধরবে না।

তিনি বলেন, বারি থেকে অ্যাভোকাডো, রামবুটান, মাল্টা, ড্রাগন ফল, স্ট্রবেরি, লংগান, কমলা, নাশপাতিসহ বেশকিছু বিদেশি ফলের দেশের আবহাওয়া সহনশীল উন্নত জাত অবমুক্ত করেছি। এগুলোর আবাদ হচ্ছে। গফরগাঁওয়ে এক খামারিকে আমাদের উদ্ভাবিত জাতের ৫৭টি লংগানের চারা দিয়েছি। ফুল এসেছে। আমাদের উদ্ভাবিত জাতের বীজ ছোট, মাংস বেশি। এটার খুব ভালো সম্ভাবনা আছে। রাম্বুটানও হচ্ছে। লংগান ও রাম্বুটান লিচুর মতো। স্বাদ ও বাজারমূল্যও খুব ভালো। পার্সিমন জাপানি ফল। বাংলাদেশে চাষও হচ্ছে। তবে কিছুটা কষ ভাব আছে। শিগগিরই ভালো জাত দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের আবহাওয়ায় এই ফলটা হওয়ার ভালো সম্ভাবনা আছে। জাবটিকাবা, টিসা, পার্সিমন, ম্যাংগোস্টিন, স্টার আপেলসহ অনেক বিদেশি ফলের জাত উন্মোচনের চেষ্টা করছি। শিগগিরই কয়েকটি মাঠ পর্যায়ে দিতে পারব। তবে ৪৮টি আঙ্গুরের জাত নিয়ে গবেষণা করে দুই ভালো জাত পেয়েছিলাম। পোকার আক্রমণ বেশি হওয়ায় সেগুলো কৃষকদের দেইনি। তবে অনেকেই আবাদ করছেন। আপেল নিয়ে গবেষণা চলছে। আমাদের গবেষণাগারে ফলও হয়েছিল। পরে গাছ মারা গেছে। এ ছাড়া রকমেলান, ব্রেড ফ্রুট, মালবেরি, ত্বিনসহ বেশ কিছু ফল দেশে কম-বেশি হচ্ছে।

গণভবনে ফলের আবাদ : বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪ লাখ ৩১ হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য পতিত জমি রয়েছে, যা মোট আবাদযোগ্য জমির প্রায় পাঁচ শতাংশ। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা আরও শক্ত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি ইঞ্চি জমির সুষ্ঠু ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছেন। নিজের সরকারি বাসভবন গণভবনের বিশাল আঙ্গিনায় হাঁস-মুরগি, কবুতর, গরু পালনের পাশাপাশি শাকসবজি, ফুল, ফল, মধু ও মাছ চাষ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ফলিয়েছেন তিল, সরিষা, পিঁয়াজ, বাঁশফুল, পোলাও চাল, লাল চাল, পালংশাক, ধনেপাতা, বতুয়া শাক, ব্রোকলি, টমেটো, লাউ, শিম, বিভিন্ন ধরনের মসলা, আম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, বরই, ড্রাগন, স্ট্রবেরিসহ নানা ফসল।

দেশে আবাদ হওয়া কিছু বিদেশি ফল-

রাম্বুটান : অত্যন্ত রসালো এ ফলটির উৎপত্তি থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও মিয়ানমারে। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি রাম্বুটান-১ নামে একটি জাত মুক্ত করেছে। দেশে রাম্বুটানের বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

পার্সিমন : জাপানের প্রধান ফল। অত্যন্ত পুষ্টিকর। শীত প্রধান অঞ্চলের ফসল। বাংলাদেশে জুলাই-সেপ্টেম্বরে ফল পাকে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টারে ৩টি বড় গাছ আছে, যা থেকে ২০১০ সাল থেকে ফল দিচ্ছে। এ ছাড়া নাটোর মডার্ন হর্টিকালচার সেন্টার, নওগাঁর বরেন্দ্র এগ্রো পার্কসহ বিভিন্ন হর্টিকালচার সেন্টারে পার্সিমন হচ্ছে।

অ্যাভোকাডো : অত্যন্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন ফলটি মূলত মধ্য আমেরিকার। প্রতি ১০০ গ্রামে ২৬ ভাগ ফ্যাট। প্রচুর এইচডিএল থাকায় রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল কমায়। দুই টুকরো অ্যাভোকাডো তিন-চার ঘণ্টার ক্ষুধা দূর করতে সক্ষম। বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলার উঁচু ভূমিতে এই ফল চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। মাদারীপুর হর্টিকালচার সেন্টারে দুটি গাছেই প্রতি বছর দুই শতাধিক ফল ধরে। বর্তমানে হাটহাজারি ও অন্যান্য পার্বত্য এলাকায় সীমিত আকারে চাষ হচ্ছে।

ড্রাগন ফল : ফলটি মেক্সিকো, মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার। মে থেকে নভেম্বর সাত মাসজুড়ে ফলটি উৎপাদন সম্ভব। অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে উৎপাদিত ড্রাগন ফলের স্বাদ ও মিষ্টতা বেশি পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে প্রচুর চাষ হচ্ছে।

ম্যাংগোস্টিন : অত্যন্ত সুস্বাদু গাব প্রজাতির ফল। দেশের কিছু শৌখিন চাষির বাগানে এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হর্টিকালচার সেন্টারে চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে।

মাল্টা : ৫-৭ বছর ধরে এর চাষ দেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বারি দুটি জাত অবমুক্ত করেছে। প্রচুর ফলন পাওয়া যাচ্ছে।

থাই সফেদা : দেশি সফেদার জাতগুলো তেমন উন্নতমানের নয়। বর্তমানে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে কিছু উন্নত জাতের সফেদা এনে চাষ শুরু হয়েছে। এগুলো খুবই সুস্বাদু ও রসালো।

স্ট্রবেরি : সারা দেশেই স্ট্রবেরি উৎপাদন সম্ভব। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত স্ট্রবেরি উঠে থাকে। বারি উদ্ভাবিত দুটি জাত ফল পাকার পর দুই থেকে তিন দিন পর্যন্ত রাখা যায়।

রকমেলন : বাঙ্গির মতো মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী রকমেলন বা সাম্মাম চাষ হচ্ছে সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। বাজারমূল্য বেশি হওয়ায় চাষিও লাভবান হচ্ছে।

লংগান : থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ায় তুমুল জনপ্রিয় ফল। লিচুর মতো। দেশের অনেক স্থানে বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়েছে। আশফলের মতো দেখতে হলেও ভিয়েতনামের লংগান আকারে বড় ও স্বাদে অনন্য। ভিয়েতনামের পিংপং বিশ্বের সবচেয়ে বড় লংগানের জাত আবাদ হচ্ছে দেশেই। বাংলাদেশের আবহাওয়া ফলটির জন্য খুবই ভালো।

নাশপাতি : চীনে ফুসফুসের রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত। অত্যন্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন। চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, থাইল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, তুরস্ক ও ভারত উৎপাদনে শীর্ষে থাকলেও বর্তমানে রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর ছাড়াও চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদন হচ্ছে।

বিদেশি তরমুজ : ব্ল্যাক বেবি, গোল্ডেন ক্রাউন (হলুদ তরমুজ), ইয়েলো গোল্ড, স্মার্ট বয়- এমন নানা নামের বিদেশি জাতের তরমুজ চাষ হচ্ছে চুয়াডাঙ্গা, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। বছরে ফলন হচ্ছে দুই-তিন বার। সারা বছরই বাজারে মিলছে এসব তরমুজ।

ত্বিন : তুরস্কের এই ফলটির ঔষধি ও পুষ্টিগুণ অনন্য। দেশের অধিকাংশ নার্সারিতে বিক্রি হচ্ছে চারা। বাণিজ্যিকভাবে আবাদ না হলেও শৌখিন চাষিরা লাগাচ্ছেন। নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোরসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় আবাদ হচ্ছে। সারা বছরই ফল হয়।

কমলা : বারি কমলা ছাড়াও দেশে বর্তমানে ৮-১০ জাতের কমলা আবাদ হচ্ছে। এসব চারা বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন নার্সারিতে। ফলনও ভালো।

মালবেরি : পাহাড়ি ও শীতপ্রধান এলাকার ফল। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, থাইল্যান্ড, তাইওয়ানে বেশি হয়। বরেন্দ্র এলাকায় উজ্জ্বল সম্ভাবনা। দেশের বিভিন্ন খামারে উৎপাদন হচ্ছে।

জাবটিকাবা : ব্রাজিলিয়ান গ্রেটফুড বলা হয় জাবটিকাবাকে। দক্ষিণ আমেরিকার ফল। আকারে কালো জামের মতো। সুস্বাদু। আলাদা পরিচর্যা লাগে না। লবণাক্ত এলাকাতেও হয়। বাংলাদেশে খুব একটা আবাদ নেই। তবে বান্দরবান, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন হর্টিকালচার সেন্টারে ও শৌখিন চাষিরা আবাদ করছেন। এ ছাড়া আলুবোখারা, ক্যানিস্টেল বা জামান ফল, প্যাশন ফ্রুট, কোকো, পিচ, কিউই, ব্রেড ফ্রুট বা রুটি ফল, শানতোল, কাজুবাদাম, ডুরিয়ান, সুইট লেমন, আরবের খেজুর, চেরিসহ হরেক রকম বিদেশি ফল দেশের নার্সারিগুলো মিলছে। তাতে ফলও দেখা যাচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর