শনিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

আতঙ্ক ছড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং

♦ ঢাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৮০টি গ্যাং ♦ সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ৫ থেকে ৬ হাজার ♦ চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছে

জিন্নাতুন নূর

রাজধানীসহ সারা দেশে এখন আতঙ্ক ছড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং। চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ও যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত ১২ থেকে ২২ বছর বয়সীরা কিশোর অপরাধে জড়িত। এক-একটি এলাকায় সক্রিয় একাধিক কিশোর গ্যাং। এসব গ্যাংয়ের সদস্যদের থাকে নিজস্ব শনাক্তকরণ চিহ্নও। কারও গায়ে থাকে একাধিক ট্যাটু। এর সঙ্গে মিল রেখে তারা বিচিত্র স্টাইলে চুল কাটে এবং চুল রাঙায়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শুধু ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ৮০টি কিশোর গ্যাং। যাতে জড়িত ৩৩৯ কিশোর। ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে রাজধানীতে কিশোর অপরাধে ৪৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলার বিচারকাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৬৪ জেলা, থানা, বিভাগ ও মেট্রোপলিটন এলাকায় ৫ থেকে ৬ হাজার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যের দাপটে অতিষ্ঠ গ্রাম, পাড়া-মহল্লা ও শহরের বাসিন্দারা। সাধারণত এসব গ্যাংয়ে ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য থাকে। ঢাকার উত্তরা, তুরাগ, খিলগাঁও, দক্ষিণখান, টঙ্গী, সূত্রাপুর, ডেমরা, সবুজবাগ, খিলক্ষেত, কোতোয়ালি, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, আগারগাঁও ও হাতিরঝিলে কিশোর গ্যাং সক্রিয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে কিশোর গ্যাংয়ের যে কালচার এখন দেখা যাচ্ছে, শুরুতে তা ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক। পরে তা মেট্রোপলিটন কেন্দ্রিক বিস্তার লাভ করে। মূলত নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোররাই অপরাধে সম্পৃক্ত হচ্ছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের খুব একটা অপরাধে জড়াতে দেখা যায় না। ঢাকার বস্তি এলাকায় কিশোররা অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর, মিরপুর এবং উত্তরায় কিশোর অপরাধীর সংখ্যা বেশি। সাধারণত একটি এলাকায় যখন কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠে তখন পাল্লা দিয়ে অন্য এলাকাতেও তা গড়ে ওঠে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলায় ‘পাটালি গ্রুপ’ নামে এক কিশোর গ্যাংয়ের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ২৫ এপ্রিল চার তরুণ গুরুতর আহত হন। তারা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বছিলা ওয়াশপুর ব্রিজসংলগ্ন একটি খাবারের হোটেলে রাতে এ হামলার ঘটনা ঘটে। পাটালি গ্রুপের জুয়েল, ছোট হাসান, ফরহাদ, দীপু, চিকু সাকিল, রুবেল, শামীম, মাগুর হাসান, শাহীন, মন্নান, রফিক, ফর্মা সজীবসহ কয়েকজন এ ঘটনা ঘটায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৩ এপ্রিল কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে ফাহাদ আলী (১৭) নামে এক কিশোর নিহত হয়। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছে ইমন (১৫) নামে আরেক কিশোর। নিহত ফাহাদ ‘বাদশা’ গ্যাংয়ের লিডার ছিল। ইমন তার সহযোগী। তারা দুজনেই মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। জানা যায়, ঘুরতে গিয়ে অপর একটি কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় তাদের। একপর্যায়ে ১০-১২ কিশোর তাদের ওপর হামলা চালায়।

গত জানুয়ারিতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদাবর, শ্যামলী ও বেড়িবাঁধ এলাকায় চুরি, ছিনতাই, যৌন হয়রানি ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত কিশোর গ্যাং ‘ব্রেভ স্ট্রং কিং’-এর আট সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। জানা যায়, এ গ্রুপের সদস্যরা ‘সবুজ বাংলা গ্রুপ’, ‘টপ টেন গ্রুপ’ ও ‘ভাইবন্ধু গ্রুপ’-এর সদস্য ছিল। তারা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় ঢাকা উদ্যান, আদাবর, শ্যামলী, মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকায় মারামারিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত ছিল। তারা ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবেও কাজ করত। এসব এলাকায় তারা মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসায়ও জড়িত ছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত এলাকায় আধিপত্য বিস্তারেই প্রভাবশালীরা কিশোর অপরাধীদের বেশি ব্যবহার করছে। কয়েক বছরের অপরাধের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, মাদকসেবন ও মাদক বিক্রয়ের মতো অপরাধেও শিশু-কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া প্রযুক্তির অপব্যবহার, হিরোইজম, সিনিয়র-জুনিয়র বিরোধ, পারিবারিক বন্ধনে শিথিলতা, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। টিকটক, লাইকি, ইমো, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেতিবাচক ব্যবহারও কিশোর অপরাধকে উসকে দিচ্ছে।

সম্প্রতি কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির কারণ নিয়ে আয়োজিত এক ছায়া সংসদে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, প্রচলিত শিশু আইনে কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জটিল। বর্তমান আইন অনুযায়ী কিশোর অপরাধীদের সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু সেখান থেকে তারা কতটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিশোর অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হলে আইনের সংস্কার প্রয়োজন। তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কিশোর অপরাধীরা আসকারা পেয়ে থাকে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সমাজে আগের তুলনায় সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে শিশুরা সহিংস অনেক কনটেন্ট দেখছে। বর্তমানে শিশুরা অনেক ভিডিও গেম খেলছে, যার বেশির ভাগই সহিংসতামূলক। এসব গেম শিশুদের সহিংস করে তুলছে। শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার দুটো ক্ষেত্র- এর একটি হচ্ছে পরিবার, অন্যটি তার স্কুল। অনেক পরিবারের অভিভাবক শিশুর সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের জন্য যে ভূমিকা পালন করা দরকার তা করছেন না। আবার দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাও অনেক প্রতিযোগিতামূলক। সেখানে ব্যক্তিত্ব ও জীবন গঠনের শিক্ষা অনুপস্থিত। এসব বিষয়ই শিশুদের সহিংস করে তুলছে। তারা কিশোর অপরাধে জড়াচ্ছে।

সর্বশেষ খবর