বুধবার, ১০ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

সিলেটে সংগঠিত হচ্ছে জঙ্গি

কারান্তরিন, পাহাড় ও সমতলে থাকা সদস্যদের সমন্বয়ের চেষ্টা

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

সিলেটে ফের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে জঙ্গিরা। পার্বত্য চট্টগ্রামে র‌্যাবের সাঁড়াশি অভিযানের পর সমতলে ফিরে আসা জঙ্গিরা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে সিলেটকে। শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে তারা সিলেটে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে তারা অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। পাহাড় থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্যরা ‘আনসার আল ইসলাম’-এর সঙ্গে সমন্বয় করে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিল। নতুন করে জঙ্গিরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টার খবর পেয়ে সিলেটে অভিযান চালিয়ে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র দাওয়াতি শাখার প্রধানসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। জঙ্গিদের এই গ্রুপটি নতুন সদস্য সংগ্রহ, কারান্তরিন এবং পাহাড় ও সমতলে থাকা সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন ও প্রবাস থেকে অর্থ সংগ্রহের কাজ করত বলে জানিয়েছে র‌্যাব। গতকাল আদালতে সোপর্দ করা হলে বিচারক তাদের জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

গত সোমবার রাতভর সিলেট মহানগরীর এয়ারপোর্ট থানাধীন বড়শলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে র‌্যাব।

র‌্যাব-৯-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার মোমিনুল হক জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে সাঁড়াশি অভিযানের পর সেখানে প্রশিক্ষণরত জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সদস্যরা সমতলে ছড়িয়ে পড়েন। সংগঠনটির শুরা সদস্য ও দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদুল্লাহ মায়মুন সিলেটে ফিরে আসেন। তিনি সিলেটের দক্ষিণ সুরমার মাওলানা মাহমুদ হোসাইনের ছেলে। এরপর জঙ্গি সংগঠনটির আমির আনিসুর রহমান মাহমুদের নির্দেশে মায়মুনের সঙ্গে দেখা করে সিলেটে অবস্থান নেয় সংগঠনের সদস্য ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসনের মৃত শেখ আবদুস ছালাম মাস্টারের ছেলে আবু জাফর তাহান, চাঁদপুরের মতলব উত্তরের মৃত মোস্তফা কাজীর ছেলে আক্তার কাজী ওরফে সাঈদ ওরফে আইজল ও গোপালগঞ্জের মুকসেদপুরের মৃত আবদুর রাজ্জাক মোল্লার ছেলে সালাউদ্দিন রাজ্জাক মোল্লা। সিলেটে থেকে তারা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিল। পাশাপাশি তারা জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলাম’র সঙ্গে সমন্বয়েরও চেষ্টা চালাচ্ছিল। এর আগেও গ্রেফতারকৃত এই চারজন জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগে একাধিকবার জেল খেটেছিল।

র‌্যাব জানায়, ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদুল্লাহ মায়মুন ওরফে মুমিন স্থানীয় একটি মাদরাসা থেকে দাখিল পাস করে। অনলাইনে ফিলিস্তিন, মিয়ানমার ও ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন দেখে উগ্রবাদে আকৃষ্ট হয়। ২০১৩ সালে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে সে যোগ দেয় ‘আসনার আল ইসলামে’। একপর্যায়ে সে সংগঠনটির বিভাগীয় মাসূল (প্রধান) এর দায়িত্ব পালন করে। আনসার আল ইসলামের শীর্ষ নেতা চাকুরিচ্যুত মেজর জিয়ার সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এমনকি জঙ্গি জিয়া তার বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ২০১৯ সালে সন্ত্রাসবিরোধী একটি মামলায় গ্রেফতার হয়ে এক বছরের বেশি সময় কারাভোগ করে ২০২০ সালের শেষের দিকে জামিনে মুক্তি পায় মায়মুন। পরবর্তীতে তার জামিন বাতিল হলে সে আত্মপোপনে চলে যায়। ২০২১ সালে সে যোগ দেয় ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’য় এবং প্রশিক্ষণের জন্য পাহাড়ে চলে যায়। ‘আনসার আল ইসলামের’ সিলেট বিভাগীয় মাসূল হওয়ায় সে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র শুরা সদস্য ও দাওয়াতি শাখার প্রধানের দায়িত্ব পায়। সে সিলেট অঞ্চলে দাওয়াতি ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করত। সাংগঠনিক কাজে সে নিয়মিত পাহাড় ও সমতলে আসা-যাওয়া করত। সিলেট বিভাগ থেকে সে জঙ্গি কার্যক্রমের জন্য সদস্যও সংগ্রহ করত। শুরুর দিকে সে ‘আনসার আল ইসলামকে ১৫ লাখ টাকা অনুদান দেয়। মূলত সেই ‘আনসার আল ইসলাম’র সঙ্গে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সেতুবন্ধ তৈরি করে দেয়। সে প্রবাসে থাকা নিজের পরিচিত বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের কাছ থেকে প্রায় ৫০ লাখ টাকা সংগ্রহ করে জঙ্গি সংগঠনের জন্য। তিন-চার মাস পরপর প্রবাসে থাকা বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে ৩০-৩৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করতে পারত মায়মুন- এমন তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব। পাহাড়ে অভিযান শুরুর পর সে সমতলে এসে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে আত্মগোপনে থেকে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাত। সর্বশেষ ভুল পরিচয়ে সিলেটে বাসা ভাড়া নিয়ে ‘আনসার আল ইসলাম’-এর সঙ্গে সমন্বয় করে পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিল।

গ্রেফতারকৃত আবু জাফর তাহান এর আগে হুজির সদস্য ছিল। ২০০১ সালে সুন্দরবনে হুজির প্রশিক্ষণরত অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়। জামিনে বের হয়ে সে জেএমবিতে যোগ দেয়। ২০০৫ সালে সে আবারও গ্রেফতার হয়। ফের জামিনে বের হয়ে ২০১৮ সালে চলে যায় মধ্যপ্রাচ্যে। প্রবাসে থাকাবস্থায় সে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’য় যোগ দেয়। কিছুদিন পর দেশে ফিরে ১২ জনের একটি গ্রুপের উপনেতা হয়ে পার্বত্য অঞ্চলে প্রশিক্ষণের জন্য চলে যায়। কিন্তু তার পরিবার জানত সে মধ্যপ্রাচ্যেই আছে। পাহাড়ে অভিযান শুরু হলে সে সংগঠনের আমিরের নির্দেশে সিলেটে মায়মুনের কাছে চলে আসে। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একাধিক মামলা রয়েছে এবং সে তিনবার কারাভোগ করেছে।

গ্রেফতারকৃত আক্তার কাজী ওরফে সাঈদ ওরফে আইজল একসময় নারায়ণগঞ্জে কাপড়ের ব্যবসা করত। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ছিনতাই ও ডাকাতির ৮-১০টি মামলা ছিল। বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়ে সে জেল খাটে। ২০১৭ সালে সে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে সে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’য় যোগ দেয়। সে ‘আনসার আল ইসলাম’-এর সদস্য ছিল। ২০২১ সালে সে তথাকথিত হিজরত করে কুমিল্লার একটি মাদরাসায় কিছুদিন অবস্থান করে। পরে প্রশিক্ষণের জন্য বান্দরবানের পাহাড়ে যায়। সেখানে সে অস্ত্র চালনা ও বোমা তৈরিসহ জঙ্গি কার্যক্রমের প্রশিক্ষণ নেয়। সেও সংগঠনের আমিরের নির্দেশে সিলেটে মায়মুনের কাছে চলে আসে। গ্রেফতারকৃত সালাউদ্দিন রাজ্জাক মোল্লা ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র অন্যতম সংগঠক। ২০১৮ সালে সংগঠনটিতে যোগ দেয়। তার মিরপুরের বাসায় প্রায়ই সংগঠনের আমিরসহ শীর্ষ নেতারা বৈঠক করতেন। কারান্তরিন সদস্য এবং পাহাড় ও সমতলে থাকা সদস্যদের মধ্যে বার্তা আদান-প্রদানের দায়িত্ব পালন করত সে। ২০২২ সালে প্রশিক্ষণের জন্য পাহাড়ে যায়। সিলেটে মায়মুনের কাছে ফিরে সে সাংগঠনিক কার্যক্রম ফের চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

সর্বশেষ খবর