রবিবার, ১৪ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

চাপ সামাল দেওয়ার লক্ষ্য

শর্তের প্রতিফলন চায় আইএমএফ

মানিক মুনতাসির

চাপ সামাল দেওয়ার লক্ষ্য

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সংকট দীর্ঘায়িতই হচ্ছে। ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশেও প্রবৃদ্ধি বাধার মুখে পড়েছে। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার দুর্বল রিজার্ভ, ডলার সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রাজস্ব ও বাণিজ্য ঘাটতি, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি সর্বোপরি জাতীয় সংসদ নির্বাচন- এ রকম অনেক চাপ সঙ্গী করে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। এমন অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে কল্যাণমুখী বাজেট দিয়ে সরকার সাধারণ মানুষকে কতটুকু স্বস্তি দিতে পারবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে আরোপিত শর্তগুলোর প্রতিফলন আগামী বাজেট থেকেই দেখতে চায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।

এদিকে অর্থবিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশের মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিতে করছাড়সহ নানামুখী উদ্যোগ থাকছে আগামী বাজেটে। দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে চলতি অর্থবছরে দেওয়া বিশেষ সুবিধা প্রত্যাহার হতে পারে। করপোরেট করেও খুব একটা পরিবর্তন আসছে না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশাল লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে। এটি চলতি অর্থবছরের লক্ষ্য থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এই পরিস্থিতিতে আজ রবিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়-ব্যয় ও করকাঠামোর কৌশল নির্ধারণে এনবিআরের চেয়ারম্যান ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। বেলা ১১টায় গণভবনে অনুষ্ঠিতব্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বিশেষ ওই বৈঠকে আগামী অর্থবছরের করকাঠামো ও রাজস্ব নীতি চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে।

এটি হবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের শেষ বাজেট। যা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ১ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন বলে জানানো হয়েছে। এবারই প্রথম বাজেট বক্তৃতা অর্থবিভাগের ওয়েবসাইটে সরাসরি লাইভ স্ট্রিমিং করা হবে। নির্বাচনের আগের শেষ বাজেট হওয়ায় আগামীতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি ছিল নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী ও সংসদ সদস্যদের। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে এবারও ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হতে পারে বলে জানা গেছে।

সম্ভাব্য সংস্কার : নির্বাচনের আগে সব পক্ষকে খুশি রাখতে চায় সরকার। এ জন্য প্রতি বছরের মতো এবারও অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করার স্থায়ী ধারা বহাল রেখে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব করা হতে পারে। বেশি সম্পদ থাকলে নিয়মিত করের বাইরে সারচার্জ দিতে হয়। আগামী বাজেটে এনবিআর ধনীদের সম্পদে সারচার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। আগামী বাজেটে করদাতার ই-টিআইএন না থাকলে অনেক সুবিধা না পাওয়ার বিষয়ে কঠোরতা আনা হচ্ছে। বিদেশ ভ্রমণ সম্পর্কিত কাগজপত্র সংগ্রহ, বাড়ি, ফ্ল্যাট বা জমি কিনতে, গাড়ি এবং এ সংক্রান্ত কাগজপত্র নবায়ন করতে, যে কোনো ব্যবসায় লাইসেন্স পাওয়া বা নবায়নে, বাড়ির গ্যাস-বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি সংযোগে, জাতীয় সংসদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনসহ রাষ্ট্র পরিচালিত যে কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে, হোটেল-রেস্তোরাঁ নির্মাণে, নতুন শিল্প স্থাপন, ঠিকাদারি ব্যবসা করতে অর্থবিলে ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক থাকছে। ১এদিকে করপোরেট কর কিছুটা বাড়ানো হতে পারে। বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ এবং শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির ক্ষেত্রে সাড়ে ২২ শতাংশ, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, তামাকজাতীয় কোম্পানি, মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির করপোরেট কর সাড়ে ৩৭ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশ করা হতে পারে।

সরকারি চাকুরেদের দেওয়া হতে পারে মহার্র্ঘ্যভাতা : ২০১৫ সালে নতুন পে-স্কেল দেওয়া হয়। এরপর কেটে গেছে প্রায় ১০ বছর। মূল্যস্ফীতিও বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। যার ফলে সরকারি চাকুরেরা নতুন বেতন কাঠামোর দাবি তুলে আসছেন অনেকদিন থেকেই। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তা সম্ভব হয়নি। আগামী বাজেটে ২০ শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতার ঘোষণা আসতে পারে বলে জানা গেছে।

বাজেটের আকার : অর্থ মন্ত্রণালয়ের রূপরেখায় আগামী অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সর্বশেষ বুধবার অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাজেটের এই আকার কিছুটা বাড়িয়ে ৭ লাখ ৬৪ হাজার করার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এখানে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ কোটি টাকা, ঘাটতি ২ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা এবং সুদ পরিশোধে ব্যয় ১ লাখ ২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির হার ধরে নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে।

রাজস্ব আদায় : অর্থবছর শেষ হতে এখনো এক মাস বাকি। এরই মধ্যে এনবিআরের ঘাটতি ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এমন প্রেক্ষাপটেও আইএমএফের চাপে এনবিআরকে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশাল লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে। যা চলতি বাজেটের চেয়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা বেশি। এনবিআর স্বাভাবিকভাবে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় করে, আইএমএফ আগামী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) তার অতিরিক্ত ৬৫ হাজার কোটি টাকা আদায় করার শর্ত দিয়েছে। আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে আগামী অর্থবছরে স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির অতিরিক্ত অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৫০ শতাংশ শুল্ক-কর আদায় করতে হবে। গত ৫০ বছরে দুই শর বেশি প্রজ্ঞাপন জারি করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে করছাড় দেওয়া হয়েছে। আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আগামী অর্থবছরের রাজস্ব বাজেটে এর বেশির ভাগই বাতিল করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে নিত্যপণ্যসহ অনেক জিনিসের দাম বাড়বে। এ ছাড়া কর অবকাশ সুবিধা কমানো, রাজস্ব আদায়ে কঠোর আইনি প্রয়োগ ও প্রযুক্তির ব্যবহার, নতুন ২০ লাখ কর দাতা চিহ্নিত এবং নতুন ১৫টি কর অঞ্চল করারও শর্ত মানার চেষ্টা করা হবে। এদিকে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে।

করমুক্ত আয়সীমা : বিদ্যমান আয়কর আইন অনুযায়ী মাসে প্রকৃত আয় ২৫ হাজার টাকার বেশি হলেই একজন ব্যক্তিকে বছর শেষে কর দিতে হয়। না হলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। গত মাস ছয়েক ধরে মূল্যস্ফীতি গড়ে ৮-৯ শতাংশের ঘরে স্থির হয়ে রয়েছে। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে দিশাহারা সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের কাছ থেকে করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানোর ব্যাপক চাপ রয়েছে। কিন্তু করদাতা হারানোর ভয়ে এনবিআর এ হার বাড়াতে আপত্তি জানিয়েছে। এক্ষেত্রে আইএমএফেরও শর্ত রয়েছে। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সাধারণ মানুষকে খুশি রাখতে করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করার প্রাথমিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে আজকের সভায়।

কমাতে হবে ভর্তুকি : অনেকদিন ধরেই বাজেট ভর্তুকি কমানোর চাপ দিয়ে আসছে আইএমএফ। সংস্থাটির সন্তুষ্টিতে এরই মধ্যে দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। জুনের মধ্যে বিদ্যুতের দাম আবারও বাড়ানোর চাপ দিয়েছে আইএমএফ। তবুও আগামী অর্থবছরে খাদ্য, কৃষি ও বিদ্যুতে চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর পরিমাণ ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। যা চলতি বাজেটের তুলনায় প্রায় ২২ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে বিদ্যুতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ২৫ হাজার কোটি টাকা, কৃষিতে ২৭ হাজার কোটি টাকা এবং খাদ্যে ৮ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা, রপ্তানি প্রণোদনা, রেমিট্যান্স, পাটজাত দ্রব্যাদিসহ অন্যান্য খাতে ৪৪ হাজার ২৪৩ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। তবে ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়ানো হতে পারে।

বৈশ্বিক সংকটের কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে পারছে না সরকার। অবশ্য এশিয়ার অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বেশি। এতে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাড়িয়ে মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে চায় সরকার। এ জন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটের খসড়ায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, ভাতা এবং খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ খাতের অন্তত ২৫ লাখ সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর কথাও ভাবা হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর