খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ কাল। ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রস্তুত করা হচ্ছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে ঢাকা থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে নির্বাচন কমিশন। এরই মধ্যে গতকাল মধ্যরাতে শেষ হয়েছে প্রচার-প্রচারণাও। এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, খুলনায় সমযোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী না থাকায় এবার ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আবার ভোট কেন্দ্রে নানা শঙ্কার কথা জানিয়েছেন একাধিক প্রার্থী। তবে বিশৃঙ্খলা করলে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে কমিশন। জানা যায়, এ নির্বাচনে ২৮৯ কেন্দ্রের মধ্যে ১৬১টিকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করেছে কমিশন। বাকি ১২৮টিকে সাধারণ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ভোটের দিন নিরাপত্তায় পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও ব্যাটালিয়ন আনসার দায়িত্বে থাকবে। তদারকিতে নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম থাকবেন। গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ১৭ ও সাধারণ কেন্দ্রে ১৬ জন করে নিরাপত্তা সদস্য থাকবেন বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দীন। তিনি বলেন, ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হবে। সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে ২৮৯ কেন্দ্র ও ১ হাজার ৭৩২টি ভোটকক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের কাজ চলছে। নির্বাচন কমিশন সার্বক্ষণিক সার্বিক পরিস্থিতি মনিটর করবে। কোথাও বিশৃঙ্খলা হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কেএমপি জানায়, ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তায় ৩ হাজার ৫৬৭ পুলিশ, ৩০০ আর্মড পুলিশ ও ৩ হাজার ৮৪৮ আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। এরই মধ্যে নগরীতে ১৬টি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। কেএমপি দফতরে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। এ ছাড়া বিজিবি ও র্যাব সদস্যরা নির্বাচনের দিন সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবেন। নির্বাচন উপলক্ষে ১০ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, ভোটার সংখ্যা, প্রার্থীর বাড়িসংলগ্ন কেন্দ্র, প্রভাব বিস্তার, যাতায়াতসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় ঝুঁকিপূর্ণ ভোট কেন্দ্র চিহ্নিত করা হয়েছে।
এ বছর খুলনা সিটিতে মেয়র পদে পাঁচ এবং ৩১ সাধারণ ওয়ার্ডে ১৩৬ ও ১০ সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৩৯ জন কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে ১৩ ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের দুজন কাউন্সিলর প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।প্রার্থীদের সর্বশেষ প্রচারণা : গতকাল খুলনা সিটি নির্বাচনে প্রচারণার শেষ দিনে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা ব্যস্ত সময় পার করেছেন। এবারের নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৯। পুরুষ ২ লাখ ৬৮ হাজার ৮৩৩ এবং নারী ২ লাখ ৬৬ হাজার ৬৯৬। এদিকে গতকাল সকালে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়েই খালিশপুর থানার ১২ নম্বর ওয়ার্ড, ১ নম্বর উর্দুভাষী ক্যাম্প থেকে শুরু করে ১২, ১৩ ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় গণসংযোগ করেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক। পরে তিনি ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে বান্দাবাজার এলাকায় সিডিসি কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সময় খুলনার ধারাবাহিক উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে তিনি নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী আবদুল আউয়াল নগরীর ডাকবাংলা, রূপসা বাসস্ট্যান্ড, কদমতলা, গল্লামারী, সোনাডাঙ্গা ও নিউমার্কেট এলাকায় গণসংযোগ ও পথসভা করেন। জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী শফিকুল ইসলাম মধু ২৯ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় গণসংযোগ এবং বিভিন্ন স্থানে পথসভায় বক্তৃতা করেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম শফিকুর রহমান মুশফিক ৬, ১৪ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগ করেন।
যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা : ভোট গ্রহণ সামনে রেখে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল মধ্যরাত থেকে ১৩ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত সিটি করপোরেশন এলাকায় কোনো মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারবে না। এ ছাড়া আজ মধ্যরাত থেকে ১২ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত ট্রাক, বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, জিপ গাড়ি, পিকআপ, প্রাইভেট কার ও ইজিবাইক চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তবে অনুমতি সাপেক্ষে প্রার্থী ও তার নির্বাচনী এজেন্ট, দেশি-বিদেশি পর্যটকের ক্ষেত্রে ওই আইন শিথিল করা হয়েছে। এর বাইরে জরুরি সেবা কাজের সঙ্গে যুক্ত অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিযোগাযোগ কাজে ব্যবহৃত যানবাহনের ক্ষেত্রে ওই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না বলে ইসির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
তিন টার্গেটে আওয়ামী লীগ : সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তিন টার্গেট নিয়েছে। প্রথমত, নৌকাকে বিজয়ী করা, দ্বিতীয়ত, বিপুলসংখ্যক ভোটারকে কেন্দ্রে উপস্থিত করা এবং তৃতীয়ত, সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করা। গতকাল খুলনা প্রেস ক্লাবে ১৪ দলের সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন।
ভোট দিলেই ব্যবস্থা নেবে বিএনপি : সিটি নির্বাচনে প্রার্থীর পক্ষে কাজ করলে বা ভোট দেওয়ার অভিযোগ পেলেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খুলনা মহানগর বিএনপি। নগরীর ৩১টি ওয়ার্ডে গোপন মনিটরিং সেল গঠন করেছে দলটি। এদিকে বিএনপিবিহীন নির্বাচনী মাঠে আপাতদৃষ্টিতে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের জয় দেখছেন অনেকে। তবে নানা কারণে সমীকরণ পাল্টেও যেতে পারে বলে মনে করছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। চার মেয়র প্রার্থী সাক্ষাৎকারে বলেছেন তাঁদের প্রত্যাশা ও অভিযোগের কথা।
তালুকদার আবদুল খালেক : পরিচ্ছন্ন-সুন্দর স্বাস্থ্যকর উন্নত স্মার্ট খুলনা নগরী গড়ে তুলতে ১২ জুন নৌকা প্রতীককে বিজয়ী করার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক। তবে নিজের ভোট প্রাপ্তি নিয়ে যত না চিন্তিত তার চেয়েও কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে ভাবনা বেশি তাঁর। এর মধ্যে ৬০-৭০ পার্সেন্ট ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে নেতা-কার্মীদের নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তালুকদার খালেক বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন, আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মাদকমুক্ত নগরী গড়ে তোলাসহ সেবামূলক খাতকে শক্তিশালী করতে ৪০ দফা নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছি। নির্বাচিত হলে ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়ন করব। তিনি বলেন, ভোটারদের সবার মধ্যেই স্বতঃস্ফূর্ততা দেখেছি। তারা কেন্দ্রে গেলে উন্নয়নের স্বার্থে অবশ্যই নৌকায় ভোট দেবেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী খুলনার উন্নয়নে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা দিয়েছেন। কিন্তু করোনার কারণে সে টাকার কাজ করা সম্ভব হয়নি। তবে নগরীর ৪১৮টি রাস্তা সম্পন্ন করেছি। আড়াই শ থেকে তিন শ রাস্তা, ড্রেন-খালের কাজ এখনো চলছে। এ কাজ সম্পন্ন করতে ডিসেম্বর পর্যন্ত লাগবে। তিনি মহানগরীকে মাদকমুক্ত করতে সবার সহযোগিতা চেয়ে বলেন, জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও পরিচ্ছন্ন বাসযোগ্য ও মাদকমুক্ত মহানগরী গড়ে তোলা হবে।
মাওলানা আবদুল আউয়াল : ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আবদুল আউয়াল ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা বারবার সিদ্ধান্তে ভুল করছেন। খুলনা নগরীর দুরবস্থার জন্য কারা দায়ী, উন্নয়নের নামে সিন্ডিকেটে কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে হবে, ভোটের মাঠে তাদের প্রত্যাখ্যান করতে হবে। খুলনা সিটির উন্নয়নের পথে, অগ্রযাত্রার পথে যারা বারবার ছোবল মারে তাদের ভোটের মাধ্যমে বয়কট করতে হবে। তিনি বলেন, বিজয়ী হলে শিল্পনগরী খুলনার ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়ে পরিবেশবান্ধব বাসযোগ্য মহানগর গড়ে তুলব।
শফিকুল ইসলাম মধু : জাতীয় পার্টির প্রার্থী শফিকুল ইসলাম মধু বলেন, নির্বাচন কমিশন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি কিংবা ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। এ কারণে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি সন্তোষজনক হবে না। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নেই সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার। আমার মনে হয় তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চাইলেও পারবে না। ভোটে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। জনগণ ভোট দিতে কেন্দ্রে আসতে আগ্রহী হচ্ছে না। ৩০-৪০ পার্সেন্ট ভোটারও কেন্দ্রে আসবে কি না সন্দেহ আছে।
শফিকুর রহমান মুশফিক : স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান মুশফিক বলেন, নাগরিক সেবায় যে কার্যক্রম করা উচিত তা হয়নি। বিগত মেয়রের সময়ে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে, যার সুফল খুলনাবাসী পায়নি। রাস্তাঘাট অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়িতে ভোগান্তি বাড়ছে। প্রায় ২৫ হাজার বাড়িঘর রাস্তা থেকে নিচু হয়ে গেছে। যদি ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে মানুষ কতটা যন্ত্রণায় আছে তার প্রমাণ মিলবে।