সোমবার, ১২ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা
বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস আজ

কোমল কাঁধে ভারী বোঝা

♦ গৃহশ্রমে জড়িত সব শিশু নির্যাতনের শিকার ♦ দেশে ৪৯ লাখ শিশু শ্রমে জড়িত

জিন্নাতুন নূর

কোমল কাঁধে ভারী বোঝা

দেশের প্রচলিত আইনে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। কিন্তু কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়ে আর দুই বেলা দুই মুঠো খেতে কোমলমতি শিশুরা নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছে ভারী বোঝা। শিশুদের অহরহ জীবণের ঝুঁকি নিয়ে বাস-লেগুনায় চালকের সহকারীর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। তাদের কেউ দোকান কর্মচারী, কেউ ফুল বা চা বিক্রেতা, কেউ কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। ইটভাটা, মোটর গ্যারেজ, বিড়ির কারখানা ও গৃহশ্রমের মতো ভারী কাজেও শিশুরা জড়িত। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশুদের অনেকেই এখন শিশুশ্রমে জড়িত। এ ছাড়া সে সময় লোকসানের কারণে কারখানাগুলোতেও কম বেতনে শিশুশ্রমিক নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়। অথচ সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও তার বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব কি না এ ব্যাপারে শিশুশ্রম নিরসনের প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা সন্দিহান। এ অবস্থায় আজ দেশব্যাপী পালিত হবে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘শিশুর শিক্ষা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করি, শিশুশ্রম বন্ধ করি।’

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় ৪৯ লাখ শিশু বিভিন্ন খাতে শিশুশ্রমে জড়িত। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন কারাখানায় মালিকরা আইন অমান্য করে শিশুশ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছেন। এখন চাইলেই আগের চেয়ে বেশি শিশুশ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে। আর জোগান বেশি হওয়ায় কম মজুরিতে শিশুশ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। অথচ শিশুশ্রম আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। ‘বাংলাদেশ জাতীয় শ্রম আইন-২০০৬’ অনুযায়ী ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজ করানো হলে তা শিশুশ্রমের অন্তর্ভুক্ত হবে বলে গণ্য হবে।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে শিশুশ্রমের প্রধান কারণ অর্থনৈতিক দুরবস্থা। একটি দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকরা সংসারের অসচ্ছলতার কারণে বিদ্যালয়ে পাঠানোর বদলে শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত করেন। দেশের উত্তরাঞ্চল ও ঢাকার আশপাশের কয়েকটি ইটভাটায় কর্মরত শিশুরা জানায়, সংসারের অভাবের কারণেই তাদের মা-বাবা ইটভাটায় কাজ করতে পাঠিয়েছে। তারা আরও জানায়, প্রথম প্রথম কাজ করতে খুব কষ্ট হয়। আর ইটভাটায় একেকটি শিশুকে দৈনিক ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। কিন্তু কাজের হিসাবে তাদের দৈনিক গড় মজুরি ৩০০ টাকারও কম।

রাজধানীর লেগুনা বা বাসের চালকের সহকারী হিসেবে ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে দেখা যায়। টানা রাতদিন কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি এসব শিশু দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হয়। অনেক যাত্রী ও চালকের কাছে কেউ কেউ সামান্য ভুলে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। আর এতকিছুর পরও দিনশেষে তিন-সাড়ে তিনশ টাকার মজুরির জন্য তারা সব কষ্ট সয়ে নেয়।

গৃহশ্রমের সঙ্গে জড়িত শিশুরাও নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্যে, দেশের গৃহশ্রমের সঙ্গে জড়িত শতভাগ শিশুই নির্যাতনের শিকার। ‘বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০২২ : সংবাদপত্রের পাতা থেকে’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় ২০২২ সালে মোট গৃহশ্রমে জড়িত ১৫ জন শিশু ধর্ষণসহ নানা নির্যাতনের শিকার হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ঢাকায়। এর মধ্যে পাঁচজন নিহত, সাতজন আহত ও তিনজন আত্মহত্যা করে। এদের মধ্যে তিনজন হত্যাকান্ডের শিকার হয়।

এরই মধ্যে সরকার মালিক, শ্রমিক ও সুশীল সমাজের সঙ্গে কথা বলে ৩৮টি কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষনা করলেও এসব কাজে এখনো শিশুদের দেখা যাচ্ছে। শ্রমজীবী শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে প্রত্যাহারের লক্ষ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০ প্রণয়ন করা হয়েছে। শিশুশ্রম নিরসনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমিকের একটা বড় অংশই শিশু। ফলে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে। শিল্প খাতকে শিশুশ্রম মুক্ত ঘোষণা করার লক্ষ্যে একটি জাতীয় কোর কমিটি গঠন করা হয়েছে। এত কিছুর পরও শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না। জানা যায়, শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে সরকার চলমান প্রকল্প শেষে আরও ৫ লাখ শিশুকে শনাক্ত করে নতুন আরেকটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। আর এভাবে চলতে থাকলে খুব অল্প সময়ে শিশুশ্রম নিরসনে বাংলাদেশ সন্তোষজনক অবস্থায় পৌঁছে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন (চতুর্থ পর্যায়)-এর প্রকল্প পরিচালক মো. মনোয়ার হোসেন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিশুশ্রম নিরসন ধাপে ধাপে হচ্ছে। বর্তমানে শিশুশ্রম নিরসনের লক্ষ্যে চতুর্থ পর্যায়ে এসে ১ লাখ শিশুকে ছয় মাসের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ পেশা থেকে তুলনামূলক নিরাপদ পেশায় জড়িত হওয়ার সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, এই শিশুদের অভিভাবকদের অনেকের শিক্ষা নেই, যাতে এই শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে নিরুৎসাহিত করে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা চ্যালেঞ্জিং কাজ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর