মঙ্গলবার, ১৩ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

গাছ কেটে পার্কের উন্নয়ন!

ধ্বংসের পথে ওসমানী উদ্যান, উৎকণ্ঠা পরিবেশবিদদের

হাসান ইমন

গাছ কেটে পার্কের উন্নয়ন!

রাজধানীর ওসমানী উদ্যানে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে গাছ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন ওসমানী উদ্যান। উদ্যানটির অবস্থান নগরভবনের একেবারেই নাকের ডগায়। উদ্যানটি উন্নয়নের জন্য ২০১৭ সালে প্রকল্প নেয় সংস্থাটি। উন্নয়নের নামে বিভিন্ন সময় ১৭৩টি গাছ কেটে ফেলেছে কর্তৃপক্ষ। ভরাট করা হয়েছে পার্কে থাকা জলাধারের একাংশ। এতে কমেছে জলাধার ও সবুজায়নের পরিমাণ। উন্নয়নের কারণে ছয় বছর ধরে এ উদ্যানে আর উন্মুক্ত পরিবেশ পাচ্ছেন না নগরবাসী। শুধু এই উদ্যান নয়, একই অবস্থা বনানী পার্ক, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের। গাছ কেটে উন্নয়ন করায় পার্কগুলোতে সবুজায়ন কমেছে।

৩ জুন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) ২৮ বছরে রাজধানীর জলাধার ভরাট এবং সবুজ নিধন ওপর গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে উঠে আসে সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন ওসমানী উদ্যানটির অবকাঠামোর উন্নয়নের জন্য গাছপালা ও জলাধার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। প্রকল্পের নামে ১৭৩টির বেশি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। উদ্যানটির কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ৫২ শতাংশ। আর সবুজের পরিমাণ ৪৮ শতাংশ। তবে গাছ কেটে ফেলার বিষয়ে সরেজমিনে গিয়েও সত্যতা পাওয়া যায়। সেখানে দেখা গেছে, গাছ কেটে টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন স্থানে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া উদ্যানের বিভিন্ন অংশে কয়েকটা গাছকে মরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। আর উদ্যানটির উত্তর-পূর্ব কর্নারে গাছ না থাকায় মাঠে পরিণত হয়েছে। এ অংশে ভাসমান ছেলেদের খেলাধুলা করতে দেখা গেছে। একই সঙ্গে উদ্যানটিতে থাকা জলাধারের একাংশ ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে।

আরও দেখা গেছে, স্থাপনার ওপরে শেওলা পড়ে আছে। বিভিন্ন অংশে রডগুলো মরিচা পড়ে থাকতে দেখা যায়। আর স্থাপনার নিচের অংশে ভ্যানগাড়ি ও ভাসমান মানুষের অবস্থান দেখা যায়। একই সঙ্গে কয়েকটি চৌকিতে মানুষকে ঘুমাতেও দেখা গেছে। এ ছাড়া ভাসমান ও ছিন্নমূল মানুষের অবস্থান রয়েছে উদ্যানটিতে। এদের মধ্যে কেউ শুয়ে আছে, আবার কেউ তাস খেলছে। অনেককে বসে থাকতেও দেখা গেছে। তবে গেটম্যানকে ম্যানেজ করে ভ্যানগাড়িগুলো ভিতরে রাখেন বলে জানিয়েছেন চালকরা। একই সঙ্গে এলোমেলোভাবে রাখা নির্মাণসামগ্রী ও বড় বড় গর্ত এ উদ্যানের মধ্যে মানুষের চলাচলকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। পুকুরের ওপর নির্মাণ করা বিশালাকৃতির স্থাপনার বড় বড় রড ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। একটু অসাবধান হলেই ঘটতে পারে বড় রকমের বিপদ। তাছাড়া উদ্যানের ভিতরে নির্মাণাধীন বিভিন্ন স্থাপনা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নির্মাণাধীন স্থানে আগাছা জন্মেছে। অবশ্য ভিতরের সড়ক, গাছের গোড়া পাকাকরণ, স্ট্রিট লাইট ও ড্রেন নির্মাণসহ কিছু অবকাঠামোর কাজ করা হয়েছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ওসমানী উদ্যানসহ ঢাকার পার্ক ও খেলার মাঠ নিয়ে ২০১৭ সালে প্রকল্প গ্রহণ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে আবদ্ধ এ উদ্যান। ওসমানী উদ্যানে প্রথমে ৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প নেওয়া হলেও পরে নতুন পরিকল্পনা সংযোজন করে তা বাড়িয়ে ৮৬ কোটি টাকা করা হয়। পরে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত। এরপর আবারও পানি নিষ্কাশন, ব্যবস্থাপনা ও পরিশোধন প্রক্রিয়া যোগ করা হয়। ফলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ কোটি টাকার ওপরে।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক খায়রুল বাকের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, উদ্যানটির উন্নয়ন প্রকল্পে কোনো গাছ কাটা হয়নি। তবে যে গাছগুলো কাটা পড়ে আছে তা সম্ভবত মরে যাওয়া। গাছ মরে যাওয়ায় এসব স্থানে নতুন করে গাছ লাগানো হবে। সিটি করপোরেশন কোনো গাছ কাটেনি। জলাধার ভরাট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জলাধার ভরাট হলে প্রয়োজনে আবার খনন করা হবে।  আর ভাসমান ও ছিন্নমূল মানুষের অবস্থানের বিষয়গুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখবে। আর কাজ শুরু হলে এমনিতেই সবাই চলে যাবে।

এদিকে বিআইপির গবেষণায় আরও উঠে আসে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ওয়াকওয়ে ও সাতটি ফুড কর্নার বানানোর জন্য প্রায় ১০০টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। উদ্যানটির বর্তমানে কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ৩৭ শতাংশ। বনানী পার্কের কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা ৪২ শতাংশ ও বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ পার্কের ৩৭ শতাংশ। সার্বিকভাবে পার্কের সবুজায়ন কমেছে। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী, পাবলিক পার্ক ও খোলা পরিসরে শতকরা ৫ ভাগের বেশি জায়গায় অবকাঠামো তৈরির সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, গাছ কেটে উন্নয়ন কখনো কাম্য নয়। অথচ ওসমানী উদ্যান উন্নয়নে ইট-পাথর আর কংক্রিটকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক সবুজ পরিবেশ নষ্ট করা হয়েছে। অথচ ঢাকায় সবুজ প্রকৃতির অভাব রয়েছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে উদ্যানটি ধ্বংস করা হচ্ছে। ঢাকা শহরে পাখি ও কীটপতঙ্গের আবাসস্থল হচ্ছে উদ্যান। কিন্তু যেভাবে কংক্রিটের স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে, তাতে জীববৈচিত্র্য ও সামগ্রিকতাও নষ্ট হচ্ছে। পাখিদের কলকাকলিও কমে আসছে। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী পার্ক ও মাঠে শতকরা ৫ ভাগের বেশি জায়গায় অবকাঠামো করা যাবে না। অথচ পার্ক ও মাঠ উন্নয়নের নামে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এ উন্নয়নের নামে কয়েকটি মাঠের সবুজায়ন বেশ কমেছে। বেড়েছে কংক্রিট আচ্ছাদিতের পরিমাণ। এতে পার্ক সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে তাপমাত্রার পরিমাণ বাড়ছে। আর বায়ুদূষণের শহরে পরিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়ন ঢাকাকে বসবাস অযোগ্যতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ওসমানী উদ্যানের প্রকল্প নেওয়ার সময় আমি এবং মরহুম মোবাশ্বের হোসেন তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকনের সামনে আপত্তি দিয়েছিলাম উদ্যান এলাকায় কংক্রিট আচ্ছাদনের পরিমাণ কমানো ও সবুজায়ন বাড়ানোর জন্য। কিন্তু আমাদের আপত্তি শোনেননি। এখন মাটির নিচে পার্কিংয়ের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ফলে এই অংশের গাছগুলো কেটে ফেলতে হবে। একই সঙ্গে জলাধারের নিচের অংশে কংক্রিটের ব্যবহার রয়েছে। এর কারণে পানি শোষন করবে না মাটি। ফলে উদ্যানটির সবুজায়ন আরও কমে যাবে।

তিনি বলেন, মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস আসার পর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা হয়ে গেছে। যার কারণে উদ্যানটি অবাঞ্ছিত পরিণতির দিকে যাচ্ছে। সুতরাং মেয়রের উচিত দ্রুত প্রকল্পটির কাজ শেষ করা এবং উদ্যান এলাকায় গাছের পরিমাণ বৃদ্ধি করা।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর