বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিষাক্ত স্কিন ক্রিমে সয়লাব বাজার

৭০০ গুণের বেশি ক্ষতিকর মার্কারি পুড়ে যাচ্ছে ত্বক কমাচ্ছে স্মৃতিশক্তি কিডনি-লিভারের ক্ষতি, বাড়ছে স্কিন ক্যান্সার ও স্নায়ুরোগ

শামীম আহমেদ

ক্রিম মাখলে মুহূর্তেই ফর্সা হয়ে যাচ্ছে ত্বক! তবে রঙের এ পরিবর্তন স্থায়ী হচ্ছে না ২৪ ঘণ্টাও। উল্টো কিছুদিন যেতেই ত্বকে দেখা দিচ্ছে মেছতাসহ নানা চর্মরোগ। নমুনা পরীক্ষায় এসব ক্রিমে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন রাসায়নিক পাওয়া যাচ্ছে বিপজ্জনক মাত্রায়, যা শুধু ত্বক নয়, নানাভাবে শরীরে প্রবেশ করে ক্ষতি করছে কিডনি-লিভারসহ নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের। কমিয়ে দিচ্ছে স্মৃতিশক্তি। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) থেকে বারবার এসব বিপজ্জনক ক্রিম নিষিদ্ধ করা হলেও বাজারে এগুলোর দাপট কমছে না। দেশের অধিকাংশ সেলুনেই ব্যবহৃত হচ্ছে নিষিদ্ধ তালিকায় থাকা ক্রিমগুলো।

চিকিৎসকরা বলছেন, কোনো ক্রিমই ত্বক খুব একটা ফর্সা করতে পারে না। তাৎক্ষণিক ত্বক চকচকে করতে কিছু ক্রিমে বিপজ্জনক মাত্রায় মার্কারি, হাইড্রোকুইনোন, লেড, স্টেরয়েডের মতো রাসায়নিক ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো শুধু ত্বক নয়, নানাভাবে শরীরে প্রবেশ করে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করছে। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) গত ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদনে নাগরিকদের মার্কারিযুক্ত কসমেটিক্স ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, মার্কারিযুক্ত প্রশাধনী ব্যবহার করলে শুধু ওই ব্যক্তিই নয়, পরিবারের অন্য সদস্যরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে শিশুরা। ব্যবহারকারীর সংস্পর্শে এসে অন্যরা নিশ্বাসের সঙ্গে মার্কারি গ্রহণ করে। মার্কারি লেগে থাকা কাপড়, তোয়ালে থেকে এ বিষ অন্যদের শরীরে প্রবেশ করে। এতে শিশুদের ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয়। মা ব্যবহার করলে গর্ভের শিশুর ক্ষতি হয়। দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। গত ১ জুন ক্ষতিকর এমন ১৮টি রং ফর্সাকারী স্কিন ক্রিম ও একটি স্কিন লোশন বিক্রি ও বিতরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বিএসটিআই। ক্রিমে মার্কারির সহনশীল মাত্রা ১ পিপিএমের কম হলেও এসব স্কিন ক্রিমে মার্কারি পাওয়া গেছে সর্বনিম্ন ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ৭৩৬ পিপিএম পর্যন্ত। ১৮টি ক্রিমের মধ্যে ১৫টি পাকিস্তানের, একটি চীনের ও দুটি নামহীন প্রতিষ্ঠানের। ক্রিমগুলো হলো গোরি, চাঁদনী, নিউ ফেস, ডিউ, নুর হারবাল বিউটি ক্রিম, নুর গোল্ড বিউটি ক্রিম, গোল্ডেন পার্ল, হোয়াইট পার্ল প্লাস, ফাইজা, প্যাক্স, নাভিয়া, ফ্রেস অ্যান্ড হোয়াইট, ফেস লিফট, ফেস ফ্রেস, ডা. রাসেল নাইট ক্রিম, ফোর কে প্লাস, আনিজা গোল্ড ও জিয়াওলি। ডা. ডাভে নামে লোশনটি ভারতীয়। অথচ, এগুলোর মধ্যে নাভিয়া ও জিয়াওলি ছাড়া ১৬টি ক্রিমই গত বছর নিষিদ্ধ করেছিল বিএসটিআই। পাকিস্তানের লোয়া ইন্টারন্যাশনালের প্যাক্স হোয়াইটনিং ক্রিম গত বছর নিষিদ্ধ করা হলেও এটির বাজারজাত বন্ধ হয়নি, উল্টো একই কোম্পানির ‘নাভিয়া’ নামে নতুন ক্রিম বাজারে প্রবেশ করে। ক্রিমটির নমুনা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ৭৩৬.৫৪ পিপিএম মার্কারি পাওয়া গেছে। কিছু ক্রিমে হাইড্রোকুইনোন পাওয়া গেছে ৩০ পিপিএমের বেশি, যার সহনশীল মাত্রা ৫ পিপিএমের নিচে। এ ব্যাপারে চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এস এম রাসেল ফারুক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএসটিআই কিছু ক্রিম নিষিদ্ধ করেছে। এগুলো ছাড়াও বাজারে আরও স্টেরয়েড ক্রিম আছে, যা ব্যবহারের পর বিপদে পড়ে অনেকে আমাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসছেন। কারও মুখ পুড়ে কালচে হয়ে গেছে। স্কিন ক্যান্সার, ত্বকে ফুসকুড়ি ওঠা, ত্বক পাতলা হয়ে যাওয়া, অবাঞ্চিত লোমের আবির্ভাব, ¯œায়ুজনিত সমস্যা, মানসিক অস্থিরতা থেকে মানসিক বৈকল্য সৃষ্টিতেও ভূমিকা রাখছে এসব স্কিন ক্রিম। এগুলো ব্যবহারে ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাল সংক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষমতা কমে যায়। মনে হতে পারে ত্বকের ক্রিমে শরীরের অন্য অঙ্গের ক্ষতি কেন হবে? কিন্তু, বিষ ত্বকে লাগলেও নানাভাবে সেটা আমাদের শরীরের ভিতরে যায়। এ জন্য কিটনাশক ছিটানোর সময় মাস্ক, গ্লাভস পরতে বলা হয়। এ ক্রিমতো লাগানো হচ্ছে মুখে, যার কাছাকাছি নাক, মুখ, চোখ। তবে কিছু অনুমোদিত ক্রিম একটা নির্দিষ্ট মাত্রায়, নির্দিষ্ট সময় ব্যবহার করা যায়। অবশ্যই সেটা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ব্যবহার করতে হবে।

বারবার নিষিদ্ধ করার পরও ক্রিমগুলোর আমদানি ও বাজারজাত বন্ধ না হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএসটিআইর পরিচালক (সিএম) প্রকৌশলী নিলুফা হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ক্রিমগুলো মূলত বিদেশ থেকে আসছে। বেশির ভাগ ঢুকছে লাগেজ পার্টির মাধ্যমে। এগুলো আটকাতে আমরা এনবিআর ও কাস্টমসকে চিঠি দিয়েছি। আমরা মাঝে-মধ্যে অভিযান চালাচ্ছি। কিন্তু এত বড় বাজার আমাদের জনবল দিয়ে নজরদারি সম্ভব নয়। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যবহারকারীদেরও সচেতন হতে হবে। কারণ, দিনশেষে ক্ষতিটা তাদের।

সরেজমিন রাজধানীর বড় বড় সুপারশপে এসব নিষিদ্ধ ক্রিম খুব একটা চোখে না পড়লেও স্থানীয় বিভিন্ন কসমেটিক্স ও মনোহারি পণ্যের দোকানে থরে থরে সাজিয়ে বিক্রি করতে দেখা গেছে। কিছু দোকানদার সামনে না রাখলেও গ্রাহক চাইলে বের করে দিচ্ছেন। তবে প্রতিটা সেলুনে প্রকাশ্যেই ব্যবহৃত হচ্ছে এসব ক্রিম। নরসুন্দরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব ক্রিম কিনতে তাদের কোথাও যেতে হয় না, কোম্পানিগুলোর বিক্রয়কর্মীরা দোকানে এসে দিয়ে যান। এগুলোর দাম কিছুটা কম হলেও সেইভ করার পর মুখে ঘসে দিলে তাৎক্ষণিক চেহারা চকচকে হয়ে ওঠে। গ্রাহকরাও খুশি হন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর