শনিবার, ১৭ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

পরিবেশের হুমকি নিষিদ্ধ পলিথিন

♦ জলাবদ্ধতার মুখে পড়েছে রাজধানী ♦ যথেচ্ছ ব্যবহারে ঘটছে মারাত্মক দূষণ ♦ কার্যকর হয়নি ‘সোনালি ব্যাগ’-এর ব্যবহার

জিন্নাতুন নূর

পরিবেশের হুমকি নিষিদ্ধ পলিথিন

বাজার থেকে পণ্য বা মুদি দোকান থেকে কিছু কিনতে, গৃহস্থালি বর্জ্য ফেলতে এবং শপিং মলে কেনাকাটা করতে গিয়ে সবখানেই মানুষ এখন নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছে। কম দামে এবং সহজেই পণ্য বহন করতে পারায় এখনো দেশে পলিথিনের বিকল্প কিছু নেই। কিন্তু এর দাম দিতে হচ্ছে পরিবেশকে। মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে পরিবেশ। কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে শপিং মলগুলোয় মাত্রাতিরিক্ত পলিথিন ব্যবহারের ফলে ঢাকার পুকুর-ডোবা, ড্রেন, জলাশয়ে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। পরিবেশ অধিদফতর থেকে পলিথিনের ব্যবহার রোধে মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হলেও পলিথিন ব্যবসায়ীদের সক্রিয়তায় এবং ব্যবহারকারীর অসচেতনতায় এখনো পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। সরকার পরিবেশ দূষণ রোধে পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে ‘সোনালি ব্যাগ’-এর উদ্ভাবন করলেও দেশের বাজারে এর চাহিদা কম। ফলে সে অর্থে বাজারে এখনো সোনালি ব্যাগের বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু করা যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে পলিথিন  ব্যাগের ব্যাপক চাহিদা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় রাজধানীতে পলিথিন ব্যাগ তৈরির মূল কেন্দ্র চকবাজারের কারখানাগুলোর মেশিন বেশ কয়েকবার জব্দ করে ধ্বংস করা হলেও চাহিদা থাকায় কারখানা মালিকরা আবারও পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও বিক্রি করছেন। চকবাজার ছাড়াও টঙ্গী, কারওয়ান বাজারসহ পলিথিন ব্যাগ যেখানে তৈরি হয় এবং যে স্থান থেকে সারা দেশে সরবরাহ হয় এমন কারখানাগুলো বন্ধ করলেও কিছুদিন পর এ সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশ প্রতিদিনকে পরিবেশ অধিদফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা বলেন, পলিথিন উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত। এজন্য ব্যবহারকারীদের মধ্যে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এরই মধ্যে এর বিকল্প হিসেবে যা সহজেই মাটিতে মিশে যাবে এমন ব্যাগ উৎপাদনে সরকার থেকে বড় ধরনের অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। আর এ ব্যাগ বাজারে এলে পলিথিনের ব্যবহার কিছুটা হলেও কমবে। এর মধ্যে সোনালি ব্যাগ ব্যবহারও উৎসাহিত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসেবে শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি পলিথিনের ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। আর বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর হিসাবে, ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি পলিথিনের ব্যাগ জমা হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০০৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশে পলিথিনের ব্যবহার বেড়েছে তিন গুণের বেশি। সরকারিভাবে ২০০২ সালে সারা দেশে এইচডিপিই (হায়ার ডেনসিটি পলি ইথালিন) পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই বাজারে আবারও এর ব্যবহার শুরু হয়। যদিও পরিবেশ অধিদফতর মাঝেমধ্যে ক্ষতিকর এ পণ্য নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালায়। কিন্তু এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার এতটুকুও কমেনি। সংশ্লিষ্ট আইন বলছে, নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণের অপরাধে সর্বোচ্চ দুই বছরের সশ্রম কারাদন্ড বা ২ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডের বিধান আছে। এর পরও প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এ বর্জ্য পরিবেশের সঙ্গে মিশে পরিবেশ দূষণ করছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পলিথিন দীর্ঘ সময়েও পচে না এবং মাটির সঙ্গে না মেশার ফলে মানুষ ছাড়াও বিপুল পরিমাণ পাখি ও জলজপ্রাণী ক্ষতির শিকার হচ্ছে। পলিথিনের অতি ব্যবহারের কারণে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে পলিথিনকে চিহ্নিত করেছেন পরিবেশবিদরা। নগরীর ব্যবসায়ীরা জানান, পলিথিন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলেও এর মতো সহজলভ্য অন্য কোনো পণ্য বহনকারী মাধ্যম তাদের কাছে নেই। তারা আরও জানান, সোনালি ব্যাগের দাম তুলনামূলক বেশি আর এর চাহিদাও নেই। হাতে গোনা কিছু ক্রেতা ঘর থেকে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ নিয়ে বাজারে এলেও অধিকাংশই পলিথিনের ওপর নির্ভরশীল। নগরীর কয়েকটি কাঁচাবাজারের পণ্য বিক্রেতারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ক্রেতারা মাছ-মাংস কেনার পর তা পলিথিনের ব্যাগে করেই বাড়িতে নিয়ে যেতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। অধিকাংশ ক্রেতা নেটের ব্যাগ বা পাটের ব্যাগের পরিবর্তে পলিথিনের ব্যাগে পণ্য নিতে চান। তারা পলিথিন ছাড়া পণ্য কিনতে চান না।

বাইরে থাকলেও দেশে চাহিদা নেই সোনালি ব্যাগের : পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ড. মোবারক আহমদ খান পাটের তৈরি পচনশীল ‘সোনালি ব্যাগ’ উদ্ভাবন করেন। এ ব্যাগটি বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে একটি পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় এ ব্যাগ উৎপাদনের জন্য। এ টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক দ্রব্য কেনা হয়। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, এরই মধ্যে ব্যাগ উৎপাদনের জন্য চীন থেকে ১ কোটি টাকার বেশি মূল্যের একটি স্বয়ংক্রিয় মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। ঈদের পর আরও একটি মেশিন বসানোর কথা। টেন্ডারের কারণে মেশিন স্থাপনে কিছুটা সময় লাগছে। এ দুটি মেশিন থেকে ২ টনের বেশি সোনালি ব্যাগ উৎপাদন করা যাবে। বর্তমানে এ ব্যাগ প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে তবে এগুলো সব দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। গড়ে ৪ থেকে ৫ হাজারের মতো ব্যাগ দেশের বাইরে পাঠানো হচ্ছে। দেশি দুয়েকটি সংস্থার চাহিদা থাকলেও তারা কোথায় কীভাবে এটি কাজে লাগাচ্ছে জানা নেই। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, কানাডা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডে এসব ব্যাগের চাহিদা আছে। দেশের বাইরে সোনালি ব্যাগের দৈনিক চাহিদা ২০ টনের মতো থাকলেও তা পূরণ করা সম্ভব নয়।

ড. মোবারক আহমদ খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাজারে সোনালি ব্যাগ সরবরাহে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছেন পলিথিন ব্যবসায়ীরা। তারা এটি বাজারে আসতে দিতে চান না। আবার ব্যবহারকারীরা পলিথিন ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় ও সস্তায় তা কিনতে পারায় সোনালি ব্যাগের প্রতি আগ্রহী নন। মানুষ পরিবেশ নিয়ে খুব বেশি চিন্তিতও না। এমনকি এবার মিসরে জলবায়ু সম্মেলনেও কেউ পলিথিনের বিকল্প ব্যবহার সম্পর্কে কথা বলেননি। দেশের পরিবেশবিদরাও এ বিষয়ে কথা বলেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের এডিবির মাধ্যমে আরও দেড় শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প দিচ্ছেন। তখন আমাদের ১০ টন সোনালি ব্যাগ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা এ ব্যাগের দাম বেশি বলে মনে করছেন। কিন্তু এ ব্যাগ যে পরিবেশের ক্ষতি করছে না এবং এটি পরিষ্কার করে আবারও ব্যবহার করা যাবে, সে বিষয়টি বিবেচনায় আনছেন না। এ ব্যাগ ব্যবহারের জন্য সরকারি উদ্যোগে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে।

সর্বশেষ খবর