শনিবার, ১৭ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

মাইক দিয়ে বিক্রি সর্বরোগের ওষুধ

মারাত্মক স্বাস্থ্য ক্ষতিসহ ঘটছে মৃত্যু নীরব প্রশাসন

শামীম আহমেদ

মাসের পর মাস চিকিৎসা করেও যেসব জটিল রোগ সারাতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বেগ পেতে হয়, সে রোগ সাত দিনে নিরাময়ের গ্যারান্টি মিলছে ফুটপাতে! রাস্তায় ছালা বিছিয়ে বা ভ্যানের ওপরে বিক্রি হচ্ছে ডায়াবেটিস, হেপাটাইটিস-বি, চর্মরোগ, ভগ্নস্বাস্থ্য, বাতব্যথা, চুল পড়া, লিভার ও কিডনি রোগ, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, টিউমার, হাঁপানি, বহুমূত্র, নারী ও পুরুষের প্রজননতন্ত্র ও যৌন রোগ, অশ্ব, পাইলস, পুরাতন আমাশয়, আঁচিল, দাঁতব্যথা, পুরাতন কাশিসহ সব রোগের ওষুধ! সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে যৌন শক্তিবর্ধক ওষুধ। ফুটপাতের এসব ওষুধ খেয়ে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন মানুষ। ঘটছে মৃত্যুর ঘটনাও। বছরের পর বছর প্রকাশ্যে মাইক বাজিয়ে অবৈধভাবে এ ওষুধ বিক্রির কার্যক্রম চললেও নীরব প্রশাসন।

কিছু মৃত্যু : ফুটপাত থেকে যৌন উত্তেজক ওষুধ কিনে স্ত্রীকে খাইয়েছিলেন ফিরোজ। খেয়েছিলেন নিজেও। দুই ঘণ্টার মধ্যেই দুজনের শরীরে শুরু হয় জ্বালাপোড়া। তাদের চিৎকারে রাত দেড়টার দিকে প্রতিবেশীরা গিয়ে তাদের বিবস্ত্র অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে যান স্থানীয় ক্লিনিকে। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পথেই মৃত্যু হয় তাদের। ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর গাজীপুরে এ ঘটনা ঘটে। ওই বছরই সেপ্টেম্বরে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে যৌন উত্তেজক ওষুধ সেবনে মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় দেলোয়ার হোসেন বাবু (৫০) নামের এক ব্যবসায়ীর। ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ সাভারের ভাদাইলে ফুটপাত থেকে যৌন রোগের ওষুধ কিনে খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই বিষক্রিয়ায় ছটফট করতে করতে মারা যান মো. জিল্লুর রহমান (২৪) ও মোতালেব মিয়া (২৫) নামের দুই যুবক। একই বছর নওগাঁর মান্দায় বাবু মোল্লা (৩০) নামে এক ভটভটি চালক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার রামরাইল ইউনিয়নে মদন মিয়া (৪৫), কুষ্টিয়ার মিরপুরের বহলবাড়ীয়া ইউনিয়নে এক শিশুসহ দুজনের মৃত্যু হয় ফুটপাত থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। ২০১৭ সালে নাটোরের গুরুদাসপুরে মাইকিং শুনে ভ্যান থেকে ছেলেমেয়েদের ‘গোপন’ রোগের ওষুধ কিনে খাওয়ার পর কিডনি ও হৃদযন্ত্র অকার্যকর হয়ে এবং খাদ্যনালি ফেটে মৃত্যু হয় লাবনী আক্তার (১২) নামের এক কিশোরীর। ওই ওষুধ খেয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন আরও পাঁচজন। জীবন বাঁচাতে, রোগ সারাতে বা যৌন জীবনে বৈচিত্র্য আনতে ফুটপাত থেকে ওষুধ কিনে খেয়ে হারহামেশা মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। অনেকে স্থায়ী স্বাস্থ্যগত জটিলতায় পড়ছেন। কিছু ঘটনা সামনে এলেও অধিকাংশই থেকে যাচ্ছে আড়ালে।

ড্রাগ অ্যাক্ট অনুযায়ী ফুটপাত, বাস, ট্রেন কিংবা অনুমোদনহীন জায়গায় কোনো ধরনের ওষুধ কেনাবেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ ছাড়া ওষুধ বিক্রি করতে নিতে হবে ড্রাগ লাইসেন্স। হতে হবে ফার্মাসিস্ট। চিকিৎসা করতে প্রয়োজন চিকিৎসক সনদ। লাগবে বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন। অথচ, ফুটপাতে যিনিই ফার্মাসিস্ট, তিনিই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক! খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এসব চিকিৎসকের অধিকাংশই পার হননি স্কুলের গন্ডি। অনেকে আবার উত্তরাধিকার সূত্রে হয়েছেন চিকিৎসক! সরেজমিন রাজধানীর ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ বাসস্টান্ড, মিরপুরে এমন অসংখ্য ভ্যান বা ছালা চিকিৎসকের সন্ধান মিলেছে। আমাদের প্রতিনিধিনের পাঠানো তথ্যানুযায়ী, সারা দেশের হাট-বাজারে প্রকাশ্যে মাইক বাজিয়ে বিক্রি হচ্ছে সর্ব রোগের ওষুধ।

গতকাল জুমার নামাজের পর নিকুঞ্জ উত্তর জামে মসজিদের পাশের মাঠে দেখা হয় হেকিম ছানোয়ার হোসেনের সঙ্গে। জানালেন, মিরপুর-১ নম্বর থেকে তিনি সপ্তাহে দুই দিন এখানে আসেন। ২৯ বছর ধরে গাছ-গাছড়া দিয়ে ডায়াবেটিস, যৌনসহ প্রায় সব ধরনের ‘জটিল ও কঠিন’ রোগের ওষুধ প্রস্তুত করছেন। তার কাছে ভেষজ ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ না মিললেও কারওয়ান বাজারে গিয়ে ফুটপাতে মিলল আমদানি নিষিদ্ধ বিভিন্ন যৌন উত্তেজক ওষুধ। আম্বর শাহ (র.) শাহী জামে মসজিদে ঢোকার গেটেই চারটি ভ্যানে বিক্রি হতে দেখা যায় সর্ব রোগের ওষুধ। রাস্তার উল্টো দিকে আরও একটি ভ্যানে ওষুধ বিক্রি করছিলেন ওমর ফারুক নামের আনুমানিক ১০ বছরের এক শিশু। দোকানগুলোতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সেনারগ্রা, হাইনেক্স, হাব্বে নিশাত, হামজা নিশাত, পিল আর, কস্তুরি পাওয়ার হালুয়া, ভিগা ডিলে ¯েপ্র, জিনসেং হালুয়া ও ট্যাবলেট, হর্স পাওয়ার ম্যাসাজ অয়েলসহ নানা যৌন উত্তেজক ওষুধ। এ ছাড়া জন্ডিস, ডায়াবেটিস, দাদ, এক্সিমা, টিউমারসহ প্রায় সব ধরনের রোগের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। রয়েছে সিপ্রোফ্লোক্সাসিন, অ্যাজিথ্রোমাইসিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিকও। মসজিদের আরেক পাশে মাইক বাজিয়ে বিক্রি হচ্ছিল জননী ম্যাজিক পাওয়ার অয়েল। বিক্রেতার দাবি অনুযায়ী, ওই তেল দিয়েই পলিপাস, দাঁতব্যথা, আঁচিল, বাতব্যথাসহ অন্তত ছয়টি রোগের চিকিৎসা সম্ভব।

এভাবে ওষুধ বিক্রির ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ফুটপাতে এভাবে ওষুধ বিক্রি সম্পূর্ণ অবৈধ। এসব ওষুধ ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। মৃত্যুও হতে পারে। কিডনি, লিভার, খাদ্যনালি, পাকস্থলি, চোখ, হার্টসহ নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। স্বীকৃত বড় কোম্পানির ওষুধ হলেও তা ব্যবহারের নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রোগীর বয়স, রোগের ইতিহাস অনেককিছু দেখে চিকিৎসক ওষুধের মাত্রা নির্ধারণ করেন। এটা না মানলে হিতে বিপরীত হতে পারে। অথচ, বহু আগে থেকেই আমরা এভাবে রাস্তা-ঘাটে ওষুধ বিক্রি হতে দেখছি। এগুলো বন্ধ করতে প্রশাসনের তৎপরতা বাড়ানো উচিত। সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমসহ সবার এগিয়ে আসতে হবে। ফুটপাতে ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধ বিক্রি বন্ধে উদ্যোগ জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. আসরাফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ফুটপাতের এসব ওষুধ বিক্রেতাদের লাইসেন্স নেই। এগুলো বন্ধ করতে সারা দেশে আমাদের টিম নিয়মিত অভিযান চালায়। তবে মানুষকেও সচেতন হতে হবে।

সর্বশেষ খবর