সোমবার, ১৯ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

হারিয়ে যাচ্ছে গরুর গাড়ি

সাইফুল ইসলাম, যশোর

হারিয়ে যাচ্ছে গরুর গাড়ি

ও কি গাড়িয়াল ভাই/কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়ারে...

গাড়িয়াল বিরহে কাতর স্ত্রীর আপন মনে গেয়ে যাওয়া এই ভাওয়াইয়া গান আজও বাঙালির কাছে জনপ্রিয়। যদিও যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশের ধাক্কায় গাড়িয়ালরা পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছেন। গরুর গাড়িও স্থান পেতে যাচ্ছে জাদুঘরে। মন মাতানো সুরের জাদুতে ভাওয়াইয়া আরও বহুকাল মানুষের মনে টিকে থাকবে। জনপ্রিয় এ বাহনটির অল্প কিছু নিদর্শন গ্রামাঞ্চলে এখনো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষের যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে থাকা এই গরুর গাড়ি কয়েক বছর পর হয়তো আর দেখা যাবে না। হারিয়ে যাচ্ছে।

উইকিপিডিয়ার তথ্যানুযায়ী, সিন্ধু অববাহিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশে সাড়ে ৩ হাজার বছর আগে থেকেই গরুর গাড়ির ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে ফ্রান্সের আলপস পর্বতমালার গুহাচিত্রে গরুর গাড়ির ছবি প্রমাণ করে সেখানে ৫ হাজার বছর আগে থেকেই গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল। কয়েক দশক আগেও গ্রাম বাংলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গরুর গাড়ির দেখা মিলত। মাঠ থেকে ধান, পাটসহ বিভিন্ন ফসল বাড়িতে আনা, সেগুলো বিক্রি করতে হাটে নিয়ে যাওয়া, এমনকি ভাড়ায় যাত্রী পরিবহনও করা হতো গরুর গাড়িতে। গ্রামাঞ্চলের কাঁচা রাস্তাঘাট বছরের অর্ধেক সময় থাকত কর্দমাক্ত। বাকি ছয় মাস থাকত ধুলাবালিতে পূর্ণ। বড় বড় কাঠের চাকা থাকায় কাদা বা ধুলাবালি- সব রাস্তায়ই গরুর গাড়ি ছিল বিকল্পহীন। বিয়ে কিংবা নাইওর যাওয়ার জন্য ছইওয়ালা গরুর গাড়িই ছিল একমাত্র বাহন। এখনো সেই স্মৃতি মধুর হয়ে আছে যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাঁপাডাঙা গ্রামের বয়স্ক নারীদের মনে।

এ গ্রামের গৃহবধূ নূরজাহান বেগম বলেন, ‘সে সময় সব বিয়েতেই গরুর গাড়ির ব্যবহার ছিল। আমার বিয়েতেও বরযাত্রী এসেছিল গরুর গাড়িতে। আমার শ্বশুরের গরুর গাড়ি ছিল। বিয়ের পরও সেই গাড়িতেই বাবার বাড়ি যেতাম। শ্বশুরবাড়িতে একজন মায়েনদার ছিল। মায়েনদার গরুর গাড়ি চালাত।’ আরেক গৃহবধূ জহুরা বেগম বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার বিয়েতে শ্বশুরবাড়ির লোকজন ছইওয়ালা গরুর গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। এখন আর ছইওয়ালা গাড়ি দেখা যায় না। রাস্তাঘাট পাকা হয়ে গেছে। ইঞ্জিনওয়ালা গাড়ি চলছে।’ একই গ্রামের বেদানা বেগম বলেন, ‘আমার বিয়েতে বরযাত্রী গিয়েছিল ছইওয়ালা গরুর গাড়িতে। বিয়ের পরও নিজের গরুর গাড়ি নিয়ে শ্বশুর আমাকে আনতে যেতেন।’ একই গ্রামের গৃহবধূ সাহারিয়া বেগম বলেন, ‘আমার বিয়েতেও গরুর গাড়িতে করে যাওয়া হয়েছিল।’

চাঁপাডাঙা গ্রামের গাড়িয়াল মির্জা কামাল। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই গরুর গাড়িটি এখনো ব্যবহার করে চলেছেন। একসময় ফসলের মৌসুমে গরুর গাড়ি ভাড়া খাটিয়ে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করেছেন। এখন এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। গরুর গাড়িতে মাঠ থেকে ধান বা অন্য ফসল বাড়িতে আনতে যেখানে চারবার যাওয়া-আসা করতে হয়, সেখানে একটি পাওয়ার টিলারে একবারেই তা সম্ভব হচ্ছে। গ্রামের পাকা রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর, ইঞ্জিনচালিত ভ্যান, রিকশা, নসিমন, করিমন, পরিমন। কয়েক দশক আগেও চাঁপাডাঙা গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই ছিল গরুর গাড়ি। এখন পুরো গ্রামে এর সংখ্যা ৩-৪টিতে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের বাসিন্দা রহমত আলী বলেন, ‘গরুর গাড়ি চালানোর জন্য দরকার হয় বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গরু। সবাই এখন বাড়িতে গরু পোষেন মোটাতাজা করে বিক্রির জন্য।’ এ গ্রামের জয়নাল আবেদীন বাপদাদার কাছ থেকে শিখেছিলেন গরুর গাড়ি তৈরির কাজ। বললেন, ‘একসময় বছরে ১৮ থেকে ২০টি গাড়ি তৈরি করতাম। এখন ইঞ্জিনের যুগ। বাধ্য হয়ে কৃষিকাজ শুরু করেছি।’ একই গ্রামের আলাউদ্দিন হোসেন বলেন, ‘রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে মিস্ত্রিরা যশোর অঞ্চলে আসত গরুর গাড়ি বানাতে। কার্তিক মাসে এসে তারা বাবলা গাছ কেটে রেখে যেত। চৈত্রে এসে সেই কাঠ দিয়ে গাড়ি তৈরি করত।’ স্থানীয়রা বলছেন, এখন সব রাস্তা পাকা হয়ে গেছে। সেখানে ইঞ্জিনচালিত নানা রকমের যানবাহন চলাচল করে। এগুলো যেমন দ্রুতগতির, খরচও কম।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর