শিরোনাম
মঙ্গলবার, ২০ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

লাগামহীন অনুন্নয়ন ব্যয়

সরকারের পরিচালন ব্যয় বেড়েছে ঘাটতি ভর্তুকি ও প্রণোদনা কমিয়ে পরিচালন ব্যয়ের লাগাম টানার চেষ্টা ব্যর্থ

মানিক মুনতাসির

লাগামহীন অনুন্নয়ন ব্যয়

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে করা হয় ৪ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। আর আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এ ব্যয়ের আকার ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে মোট আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার। সে হিসেবে এক বছরে সরকারের পরিচালন ব্যয় বাড়বে ৬১ হাজার কোটি টাকার বেশি। অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক কাঠামোর অব্যবস্থাপনা ও অতিমূল্যায়িত প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে সরকারি অর্থের অপচয় ঘটছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এ ছাড়া বাজেট ঘাটতি, ভর্তুকি ও প্রণোদনা কমিয়ে পরিচালন ব্যয়ের লাগাম টানার চেষ্টা করা হয়েছিল গত দুই বছর; যা তেমন কোনো কাজেই আসেনি বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। এদিকে জনপ্রশাসন খাতে ৫২ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার বরাদ্দ বাড়িয়ে এবং ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বিশাল আকারের ঘাটতি রেখে নির্বাচনমুখী বাজেট ঘোষণা করেছে সরকার। এ খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য মোট ২ লাখ ৭০ হাজার ২৭০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয় ২ লাখ ১৭ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। শুধু জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য ৩২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী নিয়ে এত কথা বলা হলেও এ খাতে মাত্র ৬৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। অথচ করোনা মহামারির ধাক্কায় সরকারি হিসাবেই দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ হয়েছে। এদিকে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেটে ঘাটতিই ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা; যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশের বেশি। অর্থবছর শেষে এ ঘাটতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়েও নানা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

সূত্র জানান, করোনা মহামারির কারণে টানা দুই বছর দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি থমকে দাঁড়ায়। মহামারি শেষে অর্থনৈতিক কর্তকান্ড শুরু হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। এরপর প্রায় দেড় বছর অতিবাহিত হলেও যুদ্ধ থামেনি। যার ফলে ঘুরছে না বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের চাকা। স্থবির হয়ে আছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। সরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থানের চাকা সচল রাখার চেষ্টা করছে সরকার। দুই বছর ধরে চলে আসা করোনা মহামারি সরকারি বিনিয়োগেও এক ধরনের স্থবিরতা নিয়ে এসেছে। কেননা সরকারের অনুন্নয়ন ব্যয় বেড়েছে অনেক বেশি। বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে; যা মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়েছে অনেক গুণ। অথচ মানুষের আয় তো বাড়েইনি বরং কমেছে; যার ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে মানুষকে ধারকর্জ করতে হচ্ছে। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে জাতীয় পর্যায়েও। সরকারকেও দেশি-বিদেশি ঋণ নিতে হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। এতে ব্যালান্স অব পেমেন্টেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে। শত চেষ্টা করেও অনুন্নয়ন ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না সরকার। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় বা পরিচালন ব্যয় ধরা হয় ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা আরও বেড়ে যায়। এদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকায়।

পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে সরকারি কর্মীদের বেতন-ভাতা, পেনশন, পণ্যসেবা, ভর্তুকি প্রণোদনা, নগদ ঋণ এবং দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধে বড় একটা অংশ চলে যায়। এ বছর ভর্তুকি ও নগদ প্রণোদনায় বরাদ্দ কমিয়ে তা কিছুটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। সূত্র জানান, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের সুদ বাবদ গত অর্থবছর (২০২১-২২) সরকারকে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ৭৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা এবং একইভাবে চলতি অর্থবছর (২০২২-২৩) এ খাতে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ৮৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় হবে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, এ সুদ ও বিদেশি ঋণ পরিশোধ প্রায় তিন গুণ বেড়ে যাবে ২০২৪ সাল থেকে। তখন এই অনুন্নয়ন ব্যয়ের চাপ আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকার বাজেট ঘাটতি কমাতে না পারলে ঋণ তো করতেই হবে। এজন্য প্রয়োজন রাজস্ব আদায় বাড়ানো। আর রাজস্ব আদায় বাড়াতে হলে রাজস্ব প্রশাসনের দক্ষতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে সরকারের করজাল বিস্তৃত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি কর ফাঁকিবাজদেরও ধরতে হবে বলে তিনি মনে করেন। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির প্রস্তাব করা হয়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। এ ঘাটতিও অনুন্নয়ন খাতে এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে বলে মনে করেন ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি আরও বলেন, ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেলে অর্থনীতিতে বাইরে থেকে আসা তারল্য যোগ হয়। তাতে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বাড়ে। তা ছাড়া সেই ঋণের জন্য সরকারকে সুদও গুনতে হয়। এ বছর অবশ্য আইএমএফের চাপে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ কমানো হয়েছে। ৩৫ হাজার কোটি থেকে কমিয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। নতুন অর্থবছরে দেশি-বিদেশি ঋণের জন্য ৯৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা খরচ হবে বলে অর্থমন্ত্রী হিসাব ধরেছেন, যা মোট অনুন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশ। এদিকে মূল্যস্ফীতিও ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠেছে। মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ে সরকারের ভেতরে অস্বস্তি ও শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর