সোমবার, ২৬ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

হারিয়ে যাচ্ছে বার্ডশাহী

গাছ কাটায় রাজশাহীতে আবাস হারাচ্ছে পাখি, ৭১৪ প্রজাতির মধ্যে টিকে আছে ৩৫০ প্রজাতি

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

হারিয়ে যাচ্ছে বার্ডশাহী

দেশে এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৭১৪ প্রজাতির পাখি। এর প্রায় ৩৫০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে রাজশাহীতেই। পাখিপ্রেমীদের কাছে রাজশাহী তাই ‘বার্ডশাহী’ নামে পরিচিত। কিন্তু এই বার্ডশাহী আর থাকছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়নযজ্ঞে কাটা পড়েছে শহরের অধিকাংশ পুরনো গাছপালা। তাতে আবাস হারিয়েছে পাখিরা। আবার সৌন্দর্য বাড়ানোর নামে সড়কে বসেছে উজ্জ্বল আলোর হরেক রকমের সড়কবাতি। এতে ব্যাঘাত ঘটছে পাখির জীবনচক্রে। ‘এ চেক লিস্ট অব ওয়াটারবার্ডস অব দ্য পদ্মা রিভার চরল্যান্ড’ শীর্ষক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একদল গবেষক গবেষণাটি করেন।

অন্যদিকে, শহর ঘেঁষা পদ্মার চর পাখিদের নিরাপদ আবাস। সেখানে ফিরে আসছিল বিপন্ন পাখিরাও। পরিযায়ী পাখিরাও ফিরত নিরাপদে। কিন্তু শহরের এই আলোপথ ঘুরিয়েছে পাখিদের। বিষয়টি উদ্বেগজনক বলছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সেদিকে দৃষ্টি নেই নগর কর্তৃপক্ষের। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল এলাকায় গড়ে উঠেছে শামুকখোল কলোনি। পাখির বিষ্ঠায় পরিবেশ নষ্টের অজুহাতে ২০২০ সালে গাছের ডালপালা কেটে পাখি তাড়ানোর চেষ্টা করে কর্তৃপক্ষ। এই কান্ডের প্রতিবাদ জানান পরিবেশকর্মীরা। তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি চাপা পড়লেও ২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের সামনে একটি অর্জুন গাছ কেটে ফেলে কর্তৃপক্ষ। গাছটিতে আশ্রয় নেওয়া পাখিদের বাসায় তখন ওড়ার অপেক্ষায় ছিল শত শত শামুকখোল ছানা। এ অবস্থায় গাছ পড়ে মারা যায় কিছু ছানা, কিছু ছানা ধরে জবাই করেন লোকজন। এ ঘটনায় পাখি হত্যা ও এর আবাসস্থল ধ্বংস করায় ১ কোটি টাকা এবং পরিবেশের আনুমানিক ২ কোটি টাকার ক্ষতির অভিযোগে মামলা হয়েছে পরে। কিন্তু কারও শাস্তি হয়নি এখনো। সামাজিক বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ছোট-বড় মিলিয়ে রামেক হাসপাতাল এলাকার ২৩৮টি গাছ কাটা হয়েছে। সম্প্রতি মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস মাঠের গাছেও কোপ পড়েছে। এসব গাছে দীর্ঘদিন ধরে আবাস ছিল পাখ-পাখালির। এর বাইরে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নগরীর তালাইমারী-কাটাখালী, বন্ধগেট-সিটিহাট, ভদ্রা-পারিজাতলেক-নওদাপাড়া বাসটার্মিনাল, পোস্টাল একাডেমি-ম্যাচ ফ্যাক্টরি, ভেড়িপাড়া- হাই-টেকপার্ক-ঢালুর মোড় এবং বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের সামনের রাস্তাসহ বিভিন্ন রাস্তার উন্নয়নে কাটা পড়েছে ২ হাজার ২৭৮টি বহু বছরের পুরনো গাছ। রাজশাহী-নওহাটা-চৌমাসিয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক উন্নয়নে গাছ কাটা পড়েছে ৪৪৫টি। গাছের জায়গায় বসেছে বাহারি সড়কবাতি। কিছু গাছ থেকে গেছে তালাইমারী-সাহেববাজার-কোর্ট, তালাইমারী-ভদ্রা-রেলগেট সড়কে। এসব সড়কে গাছের ভিতর দিয়ে বসানো হয়েছে ‘রাজমুকুট’ খ্যাত ১৩টির গুচ্ছ সড়কবাতি। এ ছাড়া নগরীর প্রধান প্রধান সড়কের মোড়ে মোড়ে বসানো হয়েছে উচ্চ ক্ষমতার গুচ্ছ ফ্লাডলাইট। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে আলো ছড়াচ্ছে ভোর অবধি। ফলে শহরে আর আগের মতো পাখিদের কলকাকলি নেই। গবেষকরা বলছেন, উপচেপড়া আলোয় রাত-দিনগুলিয়ে ফেলছে পাখিরা। দেখা দিচ্ছে অস্বাভাবিকতা। এতে তাদের স্বাভাবিক জীবনচক্রে বিঘ্ন সৃষ্টি। অস্তিত্ব রক্ষায় পাখিরা যাচ্ছে অন্য ঠিকানায়। ফলে এখন দিনের বেলা কাক, চড়ুই, শালিক ছাড়া আর পাখি আগের মতো চোখে পড়ছে না।

দীর্ঘদিন ধরে পদ্মার চরে পাখিদের ছবি তোলেন পাখিপ্রেমী নাজমুল কামাল রনি। নাজমুল কামাল রনি বলেন, সারা দেশের মধ্যে রাজশাহী পাখিদের হটস্পট। রাজশাহী শহর ও পদ্মার চরে সবচেয়ে বেশি পাখপাখালির আবাস। এটি তথ্যগতভাবে প্রমাণিত। আর এ জন্যই রাজশাহী পাখিপ্রেমিদের কাছে বার্ডশাহী নামে পরিচিত। বিষয়টি আমাদের জন্য গর্বের। নীতি-নির্ধারকদের উচিত, পাখিদের আবাস ধ্বংস হয়, তাদের জীবনচক্র বিঘিœত হয় এমন কর্মকান্ড বাস্তবায়ন না করা। ১৫ বছর ধরে পদ্মার চরে পাখি শনাক্ত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিনুজ্জামান মো. সালেহ রেজা। তিনি জানান, এই শতকের প্রথম দিকে মনে করা হতো মেটেতিতির আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে গেছে। তবে ২০১৮ সালে সেটি দেখা যায় পদ্মায়। এখন অনেক মেটেতিতির এখানে দেখা যায়। তবে সব পাখি পদ্মার চরে ও রাজশাহীতে ব্রিড করতে পারছে না। ফলে তারা ফিরে গিয়ে আর ফিরছে না নতুন ঠিকানায়। আবার কিছু পাখি প্রজাতিরও হ্যাবিটেড নষ্ট হয়েছে। কারণ সড়কের বড় গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া পদ্মার চরে খাবারের প্রাচুর্যতা থাকলেও বাসা তৈরির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় পাখিরা প্রজনন করতে পারছে না। নিরাপত্তা, ফুড সিকিউরিটি ও বাসা তৈরির মতো পরিবেশ না পেলে বিপন্ন তালিকায় যুক্ত হবে অনেক পাখি।

অধ্যাপক ড. আমিনুজ্জামান মো. সালেহ রেজা আরও জানান, রাতের বেলা যে কোনো আলো পাখির জন্য ক্ষতিকর। প্রভাব পড়ে পাখির জীবনচক্রে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাদের প্রজনন। ফলে জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশেরও ক্ষতি হয়। রাতচরা এবং পরিযায়ী পাখিরা আলোতে বিভ্রান্ত হয়। এদিকে পাখি সুরক্ষা উপেক্ষা করে গাছ কাটার বিষয়টি স্বীকার করেছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম। তিনি জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পরিবেশগত সমীক্ষা করা হয়েছে। তবে সেখানে পাখির সুরক্ষার বিষয়ে কিছু আছে কি না সেটি তার জানা নেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর