শিরোনাম
বুধবার, ২৮ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকার ঐতিহ্য টমটম

মোস্তফা মতিহার

হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকার ঐতিহ্য টমটম

গল্প, উপন্যাস ও রূপকথায় ঘোড়া নিয়ে নানা ধরনের কল্পকাহিনি রয়েছে। ঘোড়া নিয়ে কোনো রাজকুমারের দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা আর যুদ্ধের ময়দানে ঘোড়ার ব্যবহারের কল্পলোকের গল্পগুলো এখনো হারিয়ে যাওয়া শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেয়। মরুভূমির দেশে ঘোড়াকে এখনো আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবেই গণ্য করা হয়ে থাকে। তবে ঢাকায় ঘোড়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঘোড়া দিয়ে টানানো গাড়ি টমটম। রাজধানী ঢাকার নবাবি আমলের আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে ঘোড়ার গাড়ি বা টমটম। পুরান ঢাকার টমটমের সঙ্গে মিশে আছে ঢাকার ঐতিহ্য ও ইতিহাসের নানা অংশ। অতীতে রাজা-বাদশাহ, আমির-ওমরাহ, জমিদাররা ঘোড়ার গাড়িকেই প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহার করতেন। বিয়ে বা বড় কোনো আনুষ্ঠানিকতায় টমটম থাকলেই অভিজাত হিসেবে গণ্য করা হতো। যাত্রী পরিবহন ছাড়াও টমটম ব্যবহৃত হয় বিয়ে, পূজা, বিভিন্ন দিবসের শোভাযাত্রা ও সিনেমার শুটিংয়ে। এসব কাজে ফুলের মালা দিয়ে আর রঙিন কাগজ কেটে নকশা বানিয়ে সাজানো হয় ঘোড়া আর গাড়ি দুটোকেই। আর কোচোয়ান ও হেলপারের জন্যও ওইসব অনুষ্ঠানে রয়েছে বিশেষ পোশাক। বিশেষ করে পুরান ঢাকার বিয়েতে ঘোড়ার গাড়ি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে ঢাকার ঐতিহ্য টমটম।

জানা যায়, ১৮ শতকের প্রথমদিকে ঢাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে আর্মেনীয়রা ছিল অন্যতম প্রভাবশালী ও বণিক সম্প্রদায় এবং ১৮৫৬ সালে সিরকো নামীয় একজন আর্মেনীয়ই প্রথম ঢাকায় টমটমের প্রচলন করেন। অর্থাৎ টমটমের গর্বিত ইতিহাস প্রায় দেড় শ বছরের। রাজকীয় এই বাহনটি প্রায় ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এ দেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকলেও এই পেশার সঙ্গে জড়িতরা জীবন ও জীবিকার তাগিদে বর্তমানে অন্য পেশার প্রতি ঝুঁকছেন। বঙ্গবাজারের নবাবি টমটম সার্ভিসের স্বত্বাধিকারী টুকু খান বলেন, ঘোড়ার খাবার ও রক্ষণাবেক্ষণ, চালক ও হেলপারের বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ জোগানো সম্ভব হচ্ছে না বলে টমটমের ব্যবসা অনেকেই বন্ধ করে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে একটি আস্তাবলের দাবি জানিয়ে এলেও এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনোরকমের সাড়া পাইনি। আগে বঙ্গবাজার, ফায়ার সার্ভিস, পশু হাসপাতাল, বকশীবাজার, নারিন্দা, সিদ্দিকবাজার, কেরানীগঞ্জসহ কয়েকটি রুটে প্রায় শতাধিক টমটম চলাচল করলেও এখন শুধু গুলিস্তান থেকে সদরঘাট রুটে মাত্র ৪০টি টমটম চলাচল করে। কয়েক বছর আগেও প্রতিটি টমটম দৈনিক প্রায় ৩ হাজার টাকার মতো আয় করলেও এখন মাত্র ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। প্রতিদিন একটি ঘোড়া প্রায় ৫০০ টাকার খাবার খায় আর টমটমের চালককে দিতে হয় ৩০০ টাকা আর হেলপারকে ২০০ টাকা। ঘোড়ার খাবার, চালক ও হেলপার বাবদ একটি গাড়ির পেছনে দৈনিক খরচ হয় ১২০০ টাকার মতো। কিন্তু একটি গাড়ি দৈনিক আয় করে ৮০০ টাকা। অর্থাৎ রাস্তায় গাড়ি নামালে প্রতিদিন ৪০০ টাকা করে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের অস্তিত্ব বর্তমানে হুমকির মুখে। সরকারি অনুদান বা পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছি। ঢাকার ঐতিহ্য ও পৈতৃক ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য ভালোবাসার কারণেই এখনো এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি। আধুনিকতার জাঁতাকলে ঢাকাই এই ঐতিহ্য বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাস, কার, অটোরিকশাসহ নানা ধরনের যানবাহনের আধিক্যের কারণে এই বাহনের কদর বর্তমানে শূন্যের কোঠায়। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের আন্তরিক ও কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া ঘোড়ার গাড়ি বা টমটমকে টিকিয়ে রাখা অসম্ভব বলে জানিয়েছেন এই পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

সর্বশেষ খবর