রাজধানীর অভিজাত এলাকা নিউ বেইলি রোডে সামাজিক শিক্ষা কেন্দ্র সরকারি প্র্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৬২ সালে বিদ্যালয়টি স্থাপিত হওয়ার পর গত ১৯৭৩ সালে এই বিদ্যাপীঠ জাতীয়করণ করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয়ের উন্নয়ন হওয়ার কথা থাকলেও এ স্কুলটি উৎখাতের চেষ্টা করেছে প্রভাবশালী একটি মহল। এ বিদ্যালয়ের এখন কোনো দরজা-জানালাই নেই। আশপাশে চাকচিক্যময় সরকারি বিভিন্ন দফতর আর অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এলাকায় এ প্রাথমিক বিদ্যালয় যেন একেবারেই বেমানান। সম্প্রতি এ বিদ্যালয়ে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে প্রতিষ্ঠানের বেহাল দশা। প্রাক প্রাথমিক থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত খাতা-কলমে মোট ৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী থাকলেও কখনোই বিদ্যালয়ে ১০ থেকে ১২ জনের বেশি দেখা যায় না। এ বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী খেটে খাওয়া, দিনমজুর, নিম্নবিত্ত পরিবারের। অনেক শিক্ষার্থী অন্যের বাড়িতে কাজ করে। কাজের ব্যস্ততা শেষে সময় পেলে স্কুলে আসে। তাই নিয়মিতভাবে উপস্থিত থাকে না শিক্ষার্থীরা। বিদ্যালয়ে টিনের ছাপরা থাকলেও সামনের দিকে কোনো বেড়া নেই। এমন উন্মুক্তভাবেই চলছে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শম্পা পাল প্রতিবেদককে বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সিংহভাগই ভাসমান পরিবারের সন্তান। কাজের প্রয়োজনে অভিভাবকরা শহরে এসে সন্তানদের ভর্তি করেন। কিন্তু পরে অন্যত্র চলে যায়। তাই শিক্ষার্থীরাও থাকে না। তিনি বলেন, বর্তমানে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ জমি রয়েছে এ স্কুলের। এ স্কুলের দৃষ্টিনন্দন ভবনের অনুমোদন হয়েছে। ভবন হলে পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, বেইলি রোডে ধনীদের এলাকার এই সরকারি স্কুলটি উৎখাতে সোচ্চার ছিল প্রভাবশালী একটি পক্ষ। ২০১৪ সালে স্কুলটি রাতের আঁধারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন সময় বরাদ্দ এলেও কাজ করতে দেওয়া হয়নি। পরে বিভিন্ন আইনি জটিলতা পার করে স্কুলটি এখন টিকে থাকলেও নিভু নিভু করছে।তেজগাঁও রেলস্টেশনের পাশেই ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়েও প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী হতদরিদ্র আর নিম্নবিত্ত পরিবারের। কোনো কোনো ছাত্র রেলস্টেশনের পাশে কলার আড়তে দিনমজুরের কাজ করে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে স্কুলে আসে তারা। এই স্কুলের পাশেই বেশ কয়েকটি বস্তি রয়েছে। এ বিদ্যালয়ের বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রী এসব বস্তি থেকেই আসে। রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে রোটারি সরকারি প্রাথমিক বালক-বালিকা বিদ্যালয়, ইসলামিয়া সমিতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মগবাজার মোড়ে বড় মগবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বংশাল নিমতলীতে নবাবকাটরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চানখাঁরপুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়- সবখানেই একই চিত্র। এসব বিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পরিবার নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া। সপ্তাহব্যাপী ঢাকার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরেজমিনে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেছে। পারিবারিক অভাব, অনটনের কারণে পড়ালেখা চালিয়ে নিতে না পেরে ঝরে পড়ছে অনেক শিশু। সরকারের হিসেবে প্রায় ১৫ শতাংশ ঝরে পড়ার কথা বলা হলেও সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছেন- বাস্তবে ঝরে পড়ার হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি। রাজধানীর প্রায় ৮০ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেলার কোনো মাঠ নেই। অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত স্যানিটেশন সুবিধা, সুপেয় পানির সুবিধাও নেই। সরকারের প্রতিবেদনেও এমন তথ্য মিলেছে।
সূত্র জানায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জমি দখল ঠেকাতে সীমানাপ্রাচীর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির এক বৈঠকে সদস্যরা বলেন, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হলে বিদ্যালয়ের জমি অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২১-২২) বলছে, সারা দেশে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৮৪ হাজার ৬১৭ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। আর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ ছাড়া বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় জরিপ (এপিএসসি) ২০২১ এর তথ্যমতে, দেশের মাত্র ২০ হাজার ১২৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ওয়াশব্লক রয়েছে। অর্থাৎ সিংহভাগ বিদ্যালয়েই ওয়াশব্লক নেই। আর মাত্র ২২ হাজার ৯৯৭ বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার রয়েছে। সরকারি এই বিদ্যালয়গুলোর ১০ হাজার ৭৪০টিতে শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার কোনো মাঠ নেই। রাজধানীর মোহাম্মদ উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোছা. মমতাজ বেগম প্রতিবেদককে বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন অনেক মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। তাছাড়া দৃষ্টিনন্দন ভবনও পাচ্ছে অনেক বিদ্যালয়। তিনি বলেন, রাজধানীর অনেক স্কুলে খেলার মাঠ নেই, কোনো কোনো স্কুলে অবকাঠামোগত কিছু সমস্যা রয়েছে।
এদিকে সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সময় অতিক্রান্তের সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট না বেড়ে বরং কমে এসেছে। তারা জানান, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মন্ত্রণালয়ের বাজেট ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ থাকলেও চলতি অর্থবছরে তা ৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ হয়েছে। সিপিডি জানায়, বর্তমানে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। অধিকাংশ বিদ্যালয়ে ইন্টারনেট সুবিধা নেই। কিছু বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ ও প্রজেক্টর থাকলেও সেগুলো নিম্নমানের। যেগুলোতে রয়েছে সেগুলো ব্যবহারের জন্য শিক্ষকরা দক্ষ নন। ফলে অযত্নে অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে এসব সরঞ্জাম। ঝরে পড়া শিক্ষার্থী ঠেকাতে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার ওপর তাগিদ দিয়েছে সিপিডি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের করুণ দশা ও শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহের ব্যাপারে জানতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেনকে মোবাইল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। তবে সম্প্রতি তিনি প্রতিবেদককে বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যালয়গুলোতে দৃষ্টিনন্দন অবকাঠামো করে দিয়েছে সরকার। বিনামূল্যে পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বৃত্তিও দেওয়া হচ্ছে। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হোক আর মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের সন্তান- সবার জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার।