রবিবার, ২ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

সস্তার চামড়া নিয়েও চিন্তা

গরু ২০০ থেকে ৫০০, দাম নেই ছাগলের, বৃষ্টিতে ১০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হওয়ার শঙ্কা

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

সস্তার চামড়া নিয়েও চিন্তা

ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট উপজেলার ধারা বাজার। ঈদের দিন সন্ধ্যায় প্রায় শ খানেক চামড়া স্তূপ করে রাখা মেইন রোডের পাশে। বিষণ্ন মুখে পাশেই দাঁড়ানো মৌসুমি ব্যবসায়ী ইদ্রিস আলী। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ছাতা হাতে পাশ কাটিয়ে যাওয়া এক হাটুরের উক্তি- ‘কি মিয়া, চামড়া তো কিনলাইন মাগনা মাগনা! অত চিন্তা করুইন ক্যারে?’ ওপাশের জবাব- ‘চিন্তার দেখছুইন কী? অহনো তো মাল (কাঁচা চামড়া) ঢাহায় নিছি না...!’

এই কথোপকথনের মধ্য দিয়েই বোঝা যাচ্ছে- দরপতনের বৃত্ত থেকে এবারও বেরোতে পারেনি কোরবানির পশুর চামড়ার বাজার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ বছর প্রথম পর্যায়ে (লবণ ছাড়া) গরুর চামড়ার দাম গড়ে ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর ছাগলের চামড়ার কোনো দামই করেনি ক্রেতারা। রাজধানী ঢাকায় গরুর চামড়া প্রতি পিস ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হলেও কেউ কেনেনি ছাগলের চামড়া। এমন কী বিক্রি হবে না- এই আশঙ্কায় অনেক মাদরাসা ও এতিমখানাও ছাগলের চামড়া নিতে চায়নি বলে কোরবানি দাতারা অভিযোগ করেছেন। বিক্রি না হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাগলের চামড়া ময়লার ভাগাড়ে ফেলার তথ্য পাওয়া গেছে।

কাঁচা চামড়ার মাঠের চিত্র : রাজধানী ঢাকায় বড় আকারের কোরবানির গরুর চামড়ার দাম ছিল ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা। ঈদের দিন সন্ধ্যায় সায়েন্সল্যাবের ফুটপাতের খোলা হাটে বড় গরুর চামড়া ৬০০ টাকা ও মাঝারি গরুর চামড়া ৪০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। চট্টগ্রামেও কাছাকাছি দামে কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে। রাজশাহীতে চামড়ার দাম নিয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা থাকলেও গত বছরের তুলনায় সামান্য বেশি ছিল কোরবানির পশুর চামড়ার দাম। গত বছর যে চামড়া ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হতে হয়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা, এবার সেটি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের অনেকেই চামড়া বিক্রি না করে মাদরাসা ও এতিমখানাগুলোতে দান করে দিয়েছেন। চট্টগ্রামে কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবাসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম জানান, এরই মধ্যে তারা ৩ লাখ ১৯ হাজার কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন মাদরাসা ও উপজেলা পর্যায়েও চামড়া সংরক্ষণ করা হয়েছে। গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশের যুগ্ম মহামচিব অ্যাডভোকেট মোছাহেব উদ্দীন বখতিয়ার বলেন, আমাদের মাদরাসায় ইতোমধ্যে এক লাখ পিস চামড়া এসেছে। আমরা তা সংরক্ষণ করে ঢাকায় ট্যানারির সঙ্গে যোগাযোগ করছি। ঢাকা, চট্টগ্রাম ছাড়াও সারা দেশের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে জানা গেছে, সিলেট নগরীর জেলরোডের সাকিব আহমদ এবার ঈদে ২ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছিলেন গরু। বিশালাকার সেই গরুর চামড়া তাকে বিক্রি করতে হয়েছে মাত্র আড়াই শ টাকায়। তাও চামড়াটি নিয়ে যেতে হয়েছে রেজিস্ট্রারি মাঠে। বাসায় এসে যেসব মৌসুমি চামড়া কিনতে চেয়েছিলেন তারা দাম করেছেন দেড় শ টাকা। সিলেটে এবারও পানির দামে বিক্রি হয়েছে কোরবানির পশুর চামড়া। জয়পুরহাটে এবারও কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দরে চামড়া কিনে এনে গাড়ি ভাড়াও তুলতে পারেননি মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ সরকারি নীতিমালা তোয়াক্কা না করেই সিন্ডিকেট করে নিজেদের ইচ্ছেমতো চামড়া কিনছেন আড়তদাররা।

এ বিষয়ে রংপুর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুল লতিফ খান জানান, চামড়া ব্যবসায়ীরা ঈদে বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ নিয়ে চামড়া কিনেন। ট্যানারিতে চামড়া বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ট্যানারি মালিকরা চামড়া ব্যবসায়ীদের কয়েক কোটি টাকা বকেয়া রেখেছেন। একদিকে পুঁজি সংকট আর অপরদিকে লবণের দাম বাড়ায় এবারও চামড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। সংশয় দেখা দিয়েছে চামড়ার ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে।

ছাগলের চামড়া ময়লার ভাগাড়ে : উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তম দিনাজপুরের চামড়া মার্কেটের চিত্রটি আরও হতাশাজনক। সংশ্লিষ্টরা জানান, পানির দামে গরুর চামড়া বিক্রি হলেও ছাগলের চামড়া কেউ কিনছে না। রামনগর চামড়া বাজার এলাকার রাস্তায় ফেলে যাওয়া ছাগলের চামড়া পৌরসভার ময়লা পরিবহন ট্রাকে করে ফেলে দেওয়া হয়েছে ময়লার ভাগাড়ে। শুক্রবার বিকালেও দিনাজপুর পৌরসভার ময়লা পরিবহন ট্রাকে করে মাতাসাগর ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দিতে দেখা গেছে। বাজার এলাকার রাস্তার চারপাশে ছাগলের চামড়া পড়ে থাকতে দেখা গেছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ছাগলের চামড়া কেউ কিনছে না। আড়তদারদের কাছে নিয়ে গেলে তারা আগ্রহও দেখান না। রাজধানীর পোস্তা এলাকার আড়তদাররা জানান, ১০ থেকে ২০ টাকা দিয়ে ছাগলের চামড়া কেনার পর এতে লবণসহ প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রায় ৬০ টাকার কাছাকাছি বিক্রি হয়। এ কারণেই কেউ ছাগলের চামড়া কিনতে আগ্রহ দেখান না।

কোরবানির পশুর চামড়ার দাম প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ঈদুল আজহায় চামড়ার অতি সরবরাহের কারণে দাম কিছুটা কম থাকে। কিন্তু এই চামড়া যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে রাখা যায় তাহলে পরবর্তীতে ভালো দামে বিক্রি করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমরা শুধু চায়না মার্কেটে চামড়া রপ্তানি করে থাকি। লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সার্টিফিকেশন পেলে সব দেশই রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এতে করে চামড়ার বাজার চাঙা হবে। ব্যবসায়ীরা ভালো দাম পাবেন।

বৃষ্টিতে ১০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হতে পারে : কোরবানির ঈদে টানা বৃষ্টি হওয়ায় এবার ৫ থেকে ১০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ বলেন, বৃষ্টির কারণে ৫ থেকে ১০ শতাংশ চামড়া অবশ্যই নষ্ট হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যবসায়ীরা চামড়াগুলো সঠিক সময়ে সংরক্ষণ না করলে সেখানেও চামড়া নষ্টের আশঙ্কা রয়েছে। বৃষ্টির কারণে চামড়ার মান দ্রুত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় দ্রুততম সময়ে কাঁচা চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করার আহ্বান জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর