শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

সেতু আছে সড়ক নেই

সংযোগ সড়ক ছাড়াই বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে আছে সেতু, সরকারি অর্থের অপচয়। লুটপাটের উদ্দেশ্যেই এমন প্রকল্প মনে করছে বিভিন্ন মহল

শামীম আহমেদ

সেতু আছে সড়ক নেই

রাস্তা নেই তবু লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি করা হয়েছে সেতু। এমন লুটপাটের চিত্র দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

নেই কোনো সংযোগ সড়ক, অথচ নদী বা খালের ওপর বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ব্রিজ বা কালভার্ট। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব সেতু মানুষের কোনো কাজে আসছে না। এমন কালভার্টও রয়েছে যা দিয়ে ২২ বছরেও পারাপার হয়নি কোনো মানুষ। কালভার্টে জন্মেছে ঘাস, নিচ দিয়ে চলাচল করছে জনসাধারণ। কোথাও দুই পাশে নেই রাস্তা বা বাড়িঘর, তবুও দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে আছে সেতু। কিছু সেতুর নির্মাণকাজ চলছে ১০ বছর ধরে। উদ্বোধনের আগেই পুরনো হয়ে যাচ্ছে স্থাপনা। অনেক স্থানে সেতুতে উঠতে হচ্ছে ৩০ ফুট মই বেয়ে। কোথাও আবার বন্যার পানিতে সংযোগ সড়ক ধসে যাওয়ার পর দুই বছর পার হলেও হয়নি মেরামত। সেতু নির্মাণ হলেও অর্থের অভাবে সংযোগ সড়ক না হওয়ার ঘটনাও রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন অসংখ্য ব্রিজ-কালভার্টের সন্ধান মিলেছে, যার কোনো কোনোটি নির্মাণের প্রয়োজনীয়তাই ছিল না। একদিকে এসব সেতু মানুষের কোনো কাজে আসেনি, অপরদিকে সেতু নির্মাণের ফলে পলি জমে ভরাট হয়েছে ওই নদী বা খাল। বিপরীত দিকে অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ সেতু সংযোগ সড়কের অভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না বছরের পর বছর। কোথাও সেতু নির্মাণের পর ২০ বছর পার হলেও হয়নি সংযোগ সড়ক। ফলে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত এসব সেতু মানুষের কোনো কাজেই আসছে না। কার স্বার্থে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয়ে সংযোগ সড়কবিহীন এসব ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করে ফেলে রাখা হয়েছে তার সদুত্তর মেলেনি সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো থেকে।

আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে দেশে সংযোগ সড়কবিহীন অকেজো ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের খন্ডচিত্র তুলে ধরা হলো-

বরিশাল : কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বেশ কিছু সেতু সংযোগ সড়ক না থাকায় কারও কাজে আসছে না। মই বেয়ে, সিঁড়ি বানিয়ে ওইসব সেতুতে উঠতে হচ্ছে। বাকেরগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতি ইউনিয়নের রামনগর খালের ওপর নির্মিত আয়রন ব্রিজের সংযোগ সড়ক নির্মিত না হওয়ায় চলছে না যানবাহন। সিঁড়ি বেয়ে অন্তত ১০ ফুট উঁচু সেতুতে উঠতে হচ্ছে স্থানীয়দের। একই উপজেলার পোড়াধন খালের ওপর সোয়া ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এলজিইডি নির্মিত সেতুতে উঠতে হচ্ছে ৩০ ফুট মই বেয়ে। ২০২১ সালের শুরুর দিকে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলেও সংযোগ সড়ক হয়নি। বানারীপাড়া পৌর শহরের বন্দর বাজারের ফেরিঘাট থেকে দক্ষিণ নাজিরপুর হাইস্কুল সড়কে সন্ধ্যা নদীর সংযোগ খালের ওপর আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুটি সংযোগ সড়ক না থাকায় কারও কাজে আসছে না। একই উপজেলার রাজাপুর-বিষারকান্দি সড়কের বিষারকান্দি এলাকায় অন্তত ১০ বছর আগে নির্মাণ শুরু হওয়া একটি সেতুর কাজ এখনো চলছে। জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের রথখোলা-ভদ্রপাড়া খালের ওপর পূর্ব সুজনকাঠি গ্রামে প্রায় দুই বছর আগে নির্মিত আয়রন স্ট্রাকচার সেতুর সংযোগ সড়ক না থাকায় অব্যবহৃত পড়ে আছে। উজিরপুর উপজেলার ধামুরা বাজার খালের ওপর প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুর সংযোগ সড়ক না থাকায় সেতুটি কারও কাজে আসছে না।

ময়মনসিংহ : ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ ও মগটুলা ইউনিয়নে ২০০৩ সালে আইএফএডির অর্থায়নে একটি সেতু নির্মাণ করে এলজিইডি। ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও হয়নি সংযোগ সড়ক। বর্তমানে সেতুটির দায় নিতে চাইছে না কোনো দফতর। উপজেলা প্রকৌশলী তৌহিদ আহমেদ বলেন, সেতুটি আমাদের না, সংযোগ সড়ক ছাড়া এলজিইডির সেতু হয় না। সেতুটি অন্য ডিপার্টমেন্টের হতে পারে। ২ নম্বর গৌরীপুর ইউনিয়নের বায়রাউড়া গ্রামে লন্ডনি খালের ওপর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের অর্থায়নে নির্মিত হয় ৩২ ফুট দৈর্ঘ্যরে পাকা সেতু। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রায় এক বছর আগে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ করলেও সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় সেতুটি পানিবেষ্টিত হয়ে পড়ে আছে। বাঁশের সাঁকো দিয়ে পারাপার হচ্ছে মানুষ। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ফুলবাড়ীয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী সরস্বতী নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। সংযোগ সড়কের অভাবে চার বছর ধরে অব্যবহৃত সেতুটি। ধোবাউড়া উপজেলার উত্তরপাড়া এলাকায় সাঁতারখালী খালের ওপর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নির্মিত হয় একটি সেতু। পাঁচ বছর পার হলেও নির্মাণ হয়নি সংযোগ সড়ক। নান্দাইল উপজেলার রাজগাতী ইউনিয়নের কালীগঞ্জ বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নরসুন্দা নদীর ওপর সম্প্রতি ৮ কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত হয় সেতু। সংযোগ সড়কের অভাবে দুই পাড়ের মানুষ বাঁশের মই লাগিয়ে পারাপার হচ্ছেন।

মাদারীপুর : এ জেলায় বেশ কয়েকটি অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে জেলা এলজিইডি ও মাদারীপুর সদর উপজেলা এলজিইডিতে দরখাস্ত করলেও এ ব্যাপারে তথ্য মেলেনি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাদারীপুর সদর উপজেলার চরমুগরিয়া-শ্রীনদী সড়কের মিঠাপুর এলাকায় খালের ওপর কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সেতু নির্মাণ চলছে। সেতুটির সামনে নেই কোনো সড়ক বা বাড়িঘর। একই রকম চিত্র দেখা গেছে সদর উপজেলার বাংলাবাজার-কালিকাপুর সড়কের পাঁচখোলা এলাকার কাদের মাদবরের বাড়ির সামনে। কেন্দুয়া ইউনিয়নের উত্তর কাউয়াকুড়ি গ্রামের একটি খালের ওপর একটি সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। সেই সেতুর সামনেও নেই রাস্তাঘাট, বাড়িঘর। সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের মধ্যচর গ্রামে খালের ওপর একটি সেতু নির্মাণ করা হলেও তার আশপাশে নেই সড়ক বা বাড়িঘর। স্থানীয়রা বলছেন, অপ্রয়োজনীয় এসব সেতু নির্মাণ করে লাভবান হচ্ছে ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা। এগুলো বাসিন্দাদের কোনো কাজে আসছে না। খোয়াজপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য দবির মালত বলেন, আমাদের এলাকায় অনেক স্থানে সেতু দরকার কিন্তু নেই। একটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে যেটা কারও কাজে আসছে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি মাদারীপুর এলজিইডির আওতায় প্রায় ২০০ কোটি টাকার কাজ ভাগবাটোয়ারা করা হয়। মাদারীপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফ আলী খান বলেন, ২০০ কোটি টাকার কাজ ভাগবাটোয়ার ঘটনা আমি এখানে যোগদানের আগে ঘটেছে। বিস্তারিত জানা নেই।

রংপুর : কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউপির গোপিডাঙ্গা মৌলভি বাজার পাকা সেতুটির দুই পাশে কোনো রাস্তা নেই। সেতুটির একপাশ হেলে গেছে। এলাকাবাসী বাঁশের সাঁকো তৈরি করে চলাচল করছে। গঙ্গাচড়া শেখ হাসিনা সেতু সড়কের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের রুদ্রেশ্বর এলাকায় নির্মিত সেতুর সংযোগ সড়ক দুই বছর আগে বন্যায় বিলীন হয়ে যায়। ১০ গ্রামের মানুষের জন্য সেতুটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও আজ পর্যন্ত তা মেরামত হয়নি।

শ্রীমঙ্গল : মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়নের দিলবরনগর এলাকায় একটি পাহাড়ি ছড়ার ওপর ২০০১ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। ২২ বছরেও ব্রিজের গাইডওয়াল বা সংযোগ সড়ক হয়নি। পারাপার হয়নি কোনো মানুষ। ব্রিজে জন্মেছে ঘাস।

মেহেরপুর : মাথাভাঙ্গা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের বছর পার হলেও সংযোগ সড়ক হয়নি। ফলে ভোগান্তিতে রয়েছে মেহেরপুরের গাংনী ও কুষ্টিয়া দৌলতপুর উপজেলার অর্ধলক্ষ মানুষ। সংযোগ সড়কের অভাবে প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ ঘুরে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এলজিইডির গাংনী উপজেলা প্রকৌশলী ফয়সাল হোসেন জানান, কাজ শুরুতে জমির মালিকরা সংযোগ সড়কের জন্য জমি দিতে চেয়েছিলেন। এখন আর রাজি হচ্ছেন না। পিডি স্যারের অনুমোদন নিয়ে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

দিনাজপুর : সদর উপজেলার সুন্দরবন ইউনিয়নের হারগা গ্রামে শাখা গর্ভেশ্বরী নদীর ওপর মাঝখানে দেবে যাওয়া একটি সেতু চলাচলের অযোগ্য অবস্থায় ছয় বছর পড়ে আছে। সেতুটি উদ্বোধনের আগেই ভেঙে যায়। শুকনা মৌসুমে সেতুর পাশ দিয়ে অন্যের জমির ওপর দিয়ে যাতায়াত করেন পথচারীরা। বর্ষার সময় অনেকটা পথ ঘুরে চলাচল করতে হয় ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর