শিরোনাম
রবিবার, ১৬ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

মাদকের টাকায় সমৃদ্ধ সন্ত্রাসীদের ভান্ডার

৩৫ সন্ত্রাস ও জঙ্গি সংগঠনের অর্থ আসে মাদক থেকে, প্রতি বছর লেনদেন ৭০ বিলিয়ন ডলার

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

মাদকের টাকায় সমৃদ্ধ সন্ত্রাসীদের ভান্ডার

মাদক বিক্রির টাকায় সমৃদ্ধ হচ্ছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর ধনভান্ডার। দক্ষিণ এশিয়ার মাদকের রাজধানী খ্যাত মিয়ানমারের সান স্টেটে মাদক উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবহন এবং পরিবহনে নিরাপত্তা সবই করে মিয়ানমারভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো। এতে প্রতি বছর লেনদেন হয় ৭০ বিলিয়ন ডলার। যার প্রায় পুরোটাই যায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর ভান্ডারে। মাদক বেচাকেনার এ অর্থ দিয়ে সংগঠন পরিচালনা থেকে শুরু করে অস্ত্র কেনা সবই করে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মাদক সাপ্লাই হয় মিয়ানমারের সান স্টেট থেকে। মাদক বিক্রির এ টাকা যায় সন্ত্রাসী, বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনসহ নানা খাতে। তাই সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন ঠেকাতে সান স্টেটে যৌথ সার্জিক্যাল স্টাইক চালাতে হবে। তা না হলে মাদক নিয়ন্ত্রণ কিংবা সন্ত্রাসবাদের আস্ফালন ঠেকানো সম্ভব হবে না।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক হুমায়ন কবির খোন্দকার বলেন, ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলে প্রতি বছর ৭০ বিলিয়ন ডলারের মাদক বিক্রি হয়। মাদকের এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে পুরোপুরিই সম্পৃক্ত কমপক্ষে ৩৫ সন্ত্রাসী ও জঙ্গি সংগঠন। মাদক বিক্রির এ অর্থ দিয়ে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো অস্ত্র কেনা এবং সংগঠন পরিচালনার কাজে ব্যয় করে।’

এক সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড এবং চীনসহ বিভিন্ন দেশের আইস, ইয়াবাসহ কয়েক ধরনের মাদকের জোগান আসে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলখ্যাত মিয়ানমারের সান স্টেট থেকে। এ সান স্টেটের মাদকের কারখানায় উৎপাদন, পরিবহন এবং পাচার সবই নিয়ন্ত্রণ করে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। সান স্টেটে মাদক উৎপাদন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের কক্সবাজার পর্যন্ত পাচারের নেপথ্যে রয়েছে মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক কমপক্ষে ৩৫টি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন। এ বিচ্ছিন্নতাবাদী কমপক্ষে ১০টি সংগঠন সরাসরি মাদক উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুধু এ সংগঠনগুলোর রয়েছে ৩৬ আইস ও ইয়াবা কারখানা। এর মধ্যে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কাচিন ডিফেন্স আর্মির (কেডিআই) নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ১০টি ইয়াবা কারখানার। ইউনাইটেড ?উই স্টেট আর্মি (ইউডব্লিউএসএ) বাহিনীর ১৪টি, সান ন্যাশনালিটিজ পিপল লিবারেশন (এসএনপিএল) বাহিনীর চারটি, পানসাই খেও মেও ইয়াং মৌলিয়ানের অধীনে দুটি, সান ন্যাশনাল পিপল আর্মির দুটি, হো স্পেশাল পিলিস জে হোলি ট্রাক্টের অধীনে একটি, মং মিলিটাই আর্মি, সান স্টেট আর্মির (নর্থ) একটি, আনজু গ্রুপের একটি, সান স্টেট আর্মির (সাউথ) মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির (এমএনডিডিএ) একটি ইয়াবা তৈরির কারখানা রয়েছে। কারখানা থেকে ইয়াবা ও আইসের কিছু চালান চলে আসে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায়। সান স্টেট থেকে মাদক ক্যারিয়ার এবং পাচারে নিরাপত্তা দেওয়া সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে- আরাকান আর্মি (সেরন-২), তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (হি আং টাম), ন্যাশনাল ডেমোক্রেট এলায়েন্স, কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (কেএনএলএ), কাচিন ইন্ডিপেনডেন্ট অর্গানাইজেশন, কাচিন ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মি (কেএনআই), কাউংখা মিলিশিয়া, ওয়াই স্প্রিন্টার গ্রুপ, সান স্টেট আর্মি, পিপলস লিবারেশন আর্মি, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট, কুকি ন্যাশনাল আর্মি ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি, সান স্টেট আর্মি, ন্যাশনাল ইউনাইটেড ফ্রন্ট, লাহু ডেমোক্রেটি ইউনিয়ন অন্যতম। কারখানা থেকে রাখাইন পর্যন্ত আসছে ইয়াবা চালান পরিবহনের নিরাপত্তা, প্রতি পিস ইয়াবা পরিবহন ব্যয় বাবদ খরচ হয় বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০ থেকে ১৫ টাকা। যার পুরোটাই যায় মিয়ানমারভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর পকেটে। বাংলাদেশি সীমান্ত এলাকা থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পর্যন্ত পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও ১০টি সন্ত্রাসী ও জঙ্গি সংগঠন।

এ সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে- আরসা, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), ইসলামী মাহাজ, কেএনএফ, জমিউয়তুল মুজাহিদীনের মতো জঙ্গি সংগঠন এবং নবী গ্রুপ, মুন্না গ্রুপ, ডাকাত হাকিম গ্রুপ, জাবু গ্রুপ, ইসলাম গ্রুপ, জকির গ্রুপের মতো সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। সীমান্ত থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আনা পর্যন্ত প্রতি পিস ইয়াবার ‘পরিবহন ব্যয়’ নেয় ৭ থেকে ৮ টাকা। সীমান্ত পার হওয়ার পর ইয়াবার বেশির ভাগ চালান মজুদ হয় রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আনার পর তা দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাচার করে টেকনাফভিত্তিক মাদক মাফিয়ারা। এপিবিএন-১৪ (কক্সবাজার) অধিনায়ক ও অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘মাদক বিক্রির একটি অংশ যায় শরণার্থী ক্যাম্পের বিদ্যমান সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কাছে। ক্যাম্পে যে গ্রুপের অবস্থান যত শক্তিশালী তাদের ভাগের পরিমাণ তত বেশি। তাই ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘাতে জড়াচ্ছে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো।’

সর্বশেষ খবর