শিরোনাম
শনিবার, ২২ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

মহাকাশ গবেষণায় পিছিয়ে বাংলাদেশ

♦ নেই মহাকাশ প্রযুক্তির অবকাঠামো ♦ নানা সংকটে পিছিয়ে গবেষণা কার্যক্রম

জিন্নাতুন নূর

মহাকাশ গবেষণায় পিছিয়ে বাংলাদেশ

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত মহাকাশ গবেষণায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করলেও স্বাধীনতার ৫২ বছরেও এ-সম্পর্কিত কার্যক্রমে বাংলাদেশের বলার মতো কোনো সাফল্য নেই। এখন পর্যন্ত মহাকাশে দেশের প্রথম ও একমাত্র স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণই এযাবৎকালে বাংলাদেশের অন্যতম বড় অর্জন। যদিও স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশযান ও রকেট প্রস্তুতকারক-উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স। এমনকি দেশের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান ‘স্পারসো’র বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততাও ছিল না। প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছর পর এসেও স্পারসো মহাকাশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে কোনো সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি। এ জন্য দেশে মহাকাশ প্রযুক্তির অবকাঠামো যেমন- নিজস্ব স্যাটেলাইট ও গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণ, পরিচালনা ও উন্নয়ন, মহাকাশ প্রযুক্তি সম্পর্কিত গবেষণাগার স্থাপন এর কোনোটিই গড়ে ওঠেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহাকাশ গবেষণা সংস্থা হতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে নিজস্ব স্যাটেলাইট প্রযুক্তি প্রোগ্রাম থাকতে হয়, যা স্পারসোতে নেই। এ ছাড়া স্পারসোর মহাকাশ উৎক্ষেপণ স্টেশন, কক্ষপথ, নিজস্ব স্যাটেলাইট এবং এ-সংক্রান্ত প্রযুক্তি সম্পর্কিত গবেষণাগারও নেই। বিদেশি অনুদানে পরীক্ষামূলক পর্যায়ে থাকা সাধারণ মানের একটি গ্রাউন্ড স্টেশন (স্যাটেলাইট থেকে বার্তা গ্রহণ-সংরক্ষণ কেন্দ্র) ছাড়া দেশে মহাকাশ প্রযুক্তির অবকাঠামোও নেই। প্রতিষ্ঠার এত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও স্পারসো এখনো একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। আর এর অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকারের আগ্রহের অভাব। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাতীয় এ মহাকাশ সংস্থার রয়েছে তীব্র জনবল সংকট। বর্তমানে স্পারসোয় মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ১২টি পদের বিপরীতে কাজ করছেন মাত্র দুজন। এদের মধ্যে একজন শিগগিরই অবসরে যাচ্ছেন। আর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদ আছে পাঁচটি। সেখানে কাজ করছেন তিনজন। এসব পদে সহজে লোক নিয়োগ করা যায় না। কারণ নিয়ম অনুযায়ী এসব পদে কর্মরতদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পিএইচডি থাকতে হবে, এ ছাড়া  থাকতে হবে অন্য প্রতিষ্ঠানে ১২ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা, যা সহজে পাওয়া যায় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্পারসোর কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, মহাকাশ গবেষণার উন্নয়নে স্পারসোর ভূমিকা কার্যকরে সরকারি সদিচ্ছার প্রয়োজন। স্পারসোতে গবেষণার জন্য যদি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে অনুদান আসে তাহলে কিছুটা কাজ হতে পারে। আবার স্পারসো যেহেতু প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি সংস্থা, এখানে এ মন্ত্রণালয়ের আন্তরিকতাও গুরুত্বপূর্ণ।

কী করছে স্পারসো : বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো ভূপর্যবেক্ষণ বা রিমোট সেন্সিং স্যাটেলাইট না থাকায় জরুরি দুর্যোগকালে ও জাতীয় প্রয়োজনে উপগ্রহের চিত্র পাওয়ার জন্য বিদেশি স্যাটেলাইট বা গ্রাউন্ড স্টেশনের ওপর নির্ভর করতে হয়। বর্তমানে স্পারসোর যে গ্রাউন্ড স্টেশন আছে তা লো রেজুলেশন স্টেশন। এ জায়গা থেকে যে ডেটা পাওয়া যায় তা ঘূর্ণিঝড় ডিটেকশন বা মেঘ ডিটেকশনের কাজে লাগে। সাধারণত দেশে প্রতি বছর কী পরিমাণ ধান উৎপাদন হতে যাচ্ছে, বন্যার জন্য ম্যাপ তৈরি করা এবং দুর্যোগে কী পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে এর ম্যাপ তৈরি করার মতো কাজ করছে স্পারসো। তবে মহাকাশ প্রযুক্তির উন্নয়ন বিষয়ক কোনো কাজ এখন প্রতিষ্ঠানটি করছে না। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্যাটেলাইট ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (এসআইএ) ২০২১ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মতে, বৈশ্বিক মহাকাশ অর্থনীতির আকার ৩৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। সামনের দিনে মহাকাশ অর্থনীতি আরও বড় হবে। অথচ মহাকাশ অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবদান নেই। স্পারসোর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদের ২৯ নম্বর আইন দ্বারা স্পারসোকে সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হয়। এ আইনের যে ম্যান্ডেট ছিল তা ছিল অ্যাপ্লিকেশনের কম্পোনেন্ট। তা মহাকাশ প্রযুক্তি প্রয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মহাকাশ গবেষণা বলতে যা বোঝায় তা এ আইনের মধ্যে নেই। এখানে শুধু নামে মহাকাশ গবেষণার বিষয়টি আছে। আইন পরিবর্তন করলে হয়তো বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হবে। এখন পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানটি শুধু অ্যাপ্লিকেশনের কাজই করেছে। জনবল সংকটের কারণে মাঝে প্রতিষ্ঠানটির কাজে গতি কমে যায়। আবার অবসরে অনেক লোকবল চলে যাওয়ায় এসব পদে নিয়োগও একসঙ্গে হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের জন্য চেষ্টা করছি কিন্তু এ জন্য অর্থ প্রয়োজন। এক দশক ধরে এ সংস্থা কোনো প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে না। মহাকাশ গবেষণা ব্যয়বহুল। তবে আশা করছি আগামী বছরগুলোতে সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা এ খাতের গবেষণা কার্যক্রমে এগিয়ে আসবে।’

পিছিয়ে গবেষণা কার্যক্রম : প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা কার্যক্রমেও বেশ পিছিয়ে আছে। প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পর ২০১০ সালে প্রথম গবেষণার জন্য তহবিল দেওয়া শুরু করে সরকার। গবেষণার জন্য আলাদা বরাদ্দ দেওয়ার আগে স্পারসোর বিজ্ঞানীরা স্বতন্ত্রভাবে বা কোনো প্রকল্পের আওতায় গবেষণা করতেন। এশিয়া প্যাসিফিক স্পেস কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এপিএসসিও) সদস্য দেশ হওয়ায় সংগঠনটির কাছ থেকে অনুদান হিসেবে বাংলাদেশ পেয়েছে একটি সাধারণ মানের জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন। বর্তমানে এটি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে চালু হয়েছে। এটিই বর্তমানে দেশের একমাত্র গ্রাউন্ড স্টেশন, যার মাধ্যমে স্যাটেলাইট থেকে বার্তা গ্রহণ ও সংরক্ষণ করা হয়। তবে এখন অন্য দেশের স্যাটেলাইটের ডেটা ব্যবহার করে স্পারসোর বিজ্ঞানীরা গবেষণা করছেন। বিদেশি স্যাটেলাইট থেকে কখনো কিনে, আবার কখনো বিনামূল্যে ডেটা নিতে হয়।

সর্বশেষ খবর