বুধবার, ২৬ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা

অর্থনীতিতে নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ

♦ নির্বাচনী বছরে ইসিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ♦ ডলার সংকটের কারণে ইভিএম কেনা থেকে সরে এসেছে নির্বাচন কমিশন ♦ জিনিসপত্রের দাম কমার লক্ষণ নেই ♦ মূল্যস্ফীতিও চড়া ♦ রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়লেও রিজার্ভ বাড়ছে ধীরগতিতে

মানিক মুনতাসির

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র পাঁচ মাস। এর ইমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো নানা রকম রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে শুরু করেছে। অন্যদিকে দেশের বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম আকাশচুম্বী। মূল্যস্ফীতিও দুই অঙ্কের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। যদিও গত জুনে মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমেছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়লেও রিজার্ভ বাড়ছে ধীরগতিতে। পয়লা জুলাই থেকে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছর ২০২৩-২৪ বাজেটে নির্বাচনী বছরে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার। যদিও আর্থিক সংকটের কারণে ইভিএম কেনা থেকে সরে এসেছে কমিশন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারও কোনো রাজনৈতিক সহিংসতা হলে সামষ্টিক অর্থনীতি আরও বেশি চাপে পড়বে। একই সঙ্গে গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বেশি পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৫ কিংবা ২০১৮ সালের মতো সহিংসতা যেন না ঘটে এ জন্য সব রাজনৈতিক দলকে দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এবার এমন এক পরিস্থিতিতে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যখন সারাবিশ্বের অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ  করছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির পর শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সারাবিশ্বই এক কঠিন সময় পার করছে। দেশের অভ্যন্তরে সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। যার ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ ১২ বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। যদিও দেশে জুন-২০২৩ মাসে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশে। যা মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, জুন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে এ দাঁড়িয়েছে যা মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। এমনিতেই মানুষের আয় কমে গেছে। অন্যদিকে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে সবক্ষেত্রেই। নির্বাচনের সময়ে জিনিসপত্রের দাম নাগালের মধ্যে আনা বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ইসির নামে। যা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ব্যয়ের তুলনায় ৯৮৩ কোটি টাকার বেশি। এরমধ্যে শুধু পুলিশ বিভাগই চেয়েছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা।

অর্থবিভাগের তথ্য বলছে, পঞ্চম জাতীয় সংসদে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ১৭ কোটি টাকা, ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে ২৯ কোটি, সপ্তম সংসদে ১৮ কোটি, অষ্টম সংসদে ৪২ কোটি, নবম জাতীয় সংসদে ৯৮ কোটি ও দশম সংসদে ১৮৩ কোটি টাকা। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বরাদ্দ ছিল ৩০০ কোটি টাকার বেশি। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের বাজেট ছিল প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। যদিও শেষ পর্যন্ত সব আসনে নির্বাচন না হওয়ায় এবং বিএনপি এতে অংশ না নেওয়ায় একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ব্যয় কমে আসে। সে সময় নির্বাচনে মোট ব্যয় ২৮৩ কোটি টাকা। একইভাবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। এতে সে বছর ইসির ব্যয় হয় প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।

এদিকে সম্প্রতি ডলারের দাম বেড়ে খোলাবাজারে ১২০ টাকা অতিক্রম করে রেকর্ড গড়েছিল। সে সময় বেশ হৈচৈ পড়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় স্বল্প সময়ের মধ্যেই তা আবার কমে আসে। বর্তমানে খোলাবাজারে ১১৫ টাকায় ডলার বেচাকেনা হচ্ছে। গতকালও খোলাবাজারে ১১৫ টাকা। ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতি ডলার বিক্রি হয় হচ্ছে ১০৯ টাকায়। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক মাসের আগের তুলনায় বর্তমানে ডলারের বাজারে সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানী প্রবৃদ্ধি বাড়লে বাজারে সরবরাহ আরো বাড়বে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি বাড়ালে বাজারে অস্থিরতা কমে আসবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হচ্ছে খোলাবাজার ও আন্ত:ব্যাংক মুদ্রারবাজারের মধ্যে তফাৎটা কমানো। কিন্তু এই কাজটা করা বেশ কঠিন বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, নির্বাচনের কারণে অনেকেই হয়তো সুযোগ নিতে চাইবেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ চাইবে সতর্কভাবে পা ফেলতে। ফলে এ বছর দেশে তেমন কোন বৈদেশিক বিনিয়োগও আসার সম্ভাবনা নেই। দেশীয় বিনিয়োগ পরিস্থিতিও ভাল নয়। এছাড়া সাধারন মানুষের আয় কমে গেছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে টাকা ছাপিয়ে তা বাজারে ছেড়েছে। এতে করে সামষ্টিক অর্থনীতিটা আরো বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতি ও জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষ খানিকটা বেশি চাপে পড়েছেন বলে মনে করে খোদ সরকারি সংস্থা বিআইডিএস। শহরের মানুষকে সবকিছুই নগদ টাকায় কিনে খেতে ও ভোগ করতে হয়। যা গ্রামের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। এ ছাড়া নিজেদের খেতে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী ব্যবহারের ফলে গ্রামের মানুষের খরচের চাপ অনেকটা কম শহরের তুলনায়। অন্যদিকে গত কয়েক মাসে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়েছে যদিও সে অনুপাতে আমদানি ব্যয় কমেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এ ছাড়া ডলারের জোগান চাহিদার বিপরীতে কম থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে শ্লথগতিতে।

অন্যদিকে বাজেট বাস্তবায়নের হারও কমছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুন-মার্চ নয় মাসের বাজেট বাস্তবায়নের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বাজেটের মাত্র ৪৪ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে, যা অর্ধেকেরও কম। বাকি ৬৬ শতাংশ মাত্র তিন মাসেই ব্যয় দেখাতে হবে। যার ফলে বাজেট বাস্তবায়নের গুণাগুণ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেবে। এতেও হতাশা ব্যক্ত করেছেন অনেকেই। ফলে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরটা সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য খুবই চ্যালেঞ্জের হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর