মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের বিষাক্ত থাবা

শামীম আহমেদ

নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের বিষাক্ত থাবা

সর্বনাশা প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে দেশ। পরিবেশের জন্য হুমকি নিষিদ্ধ পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যে সয়লাব মাঠ-ঘাট, খাল-বিল, নদী-নালা। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে স্যুয়ারেজ লাইন। অপচনশীল বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী, খাল, বিলের তলদেশ। মাটি খুঁড়লে মিলছে ১৫-২০ বছরের পুরনো পলিথিন। এতে উর্বরতা কমছে মাটির। দূষিত হচ্ছে পানি। বর্ষায় পূরণ হতে পারছে না ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকছে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর দেহে। সৃষ্টি করছে ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগ। আইন করে পলিথিন নিষিদ্ধ করার পরও আশ্চর্যজনকভাবে বেড়ে চলেছে এর উৎপাদন ও ব্যবহার। বর্তমানে দেশে বছরে উৎপন্ন হচ্ছে ৮ লাখ ২১ হাজার টনের বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য। এর ৪০ ভাগ পুনর্ব্যবহার হলেও ৬০ ভাগই ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশে।

দেশে ২০০২ সালে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এ ছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পলিথিনে তৈরি সব ধরনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি ও বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ-বিতরণ নিষিদ্ধ। অথচ প্রশাসনের নাকের ডগায় বাজারগুলোতে দেদার বিক্রি হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। গড়ে উঠছে পলিথিনের নতুন নতুন কারখানা। তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে প্রায় ১ হাজার ২০০ কারখানায় পলিথিন তৈরি হচ্ছে, যার অধিকাংশই ঢাকাকেন্দ্রিক। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে বছরে এখন ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর ৪০ শতাংশ রিসাইকেল বা পুনঃব্যবহার হয়। বাকিটা পরিবেশে পড়ে থাকে। শুধু ঢাকা শহরেই বছরে প্রায় আড়াই লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যা সারা দেশে উৎপাদিত প্লাস্টিক বর্জ্যরে ৩০ ভাগের বেশি। সরকারি তথ্যানুযায়ী, সারা দেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু ৯ থেকে ১০ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন করে। রাজধানীতে মাথাপিছু প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয় ১৮ থেকে ২২ কেজি পর্যন্ত।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, পেট বোতলের মতো শক্ত প্লাস্টিকের একটা অংশ বর্জ্য শ্রমিকদের হাত ঘুরে পুনঃব্যবহার হলেও পলিথিন ব্যাগ, বিভিন্ন পণ্যের প্লাস্টিকের প্যাকেট, প্লাস্টিকের থালা, গ্লাস, কাপ শতভাগই পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে পরিবেশের। আর বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৮৭ হাজার টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক উৎপন্ন হয়। দুই দশক আগে পলিথিন নিষিদ্ধ করার আগে আকার অনুযায়ী একটা পলিথিনের ব্যাগ কিনতে হতো এক বা দুই টাকা দিয়ে। মূল্যস্ফীতি ধরলে এখন সেগুলোর দাম হওয়া উচিত অন্তত ১০-১৫ টাকা। অবাক করা বিষয় হলো বর্তমানে ২০-৩০ পয়সায় পলিথিন ব্যাগ মিলছে। দোকানিরা পাঁচটি পণ্যের সঙ্গে পাঁচটি ব্যাগ বিনামূল্যে দিয়ে দিচ্ছে। ১০০ গ্রাম মরিচ কিনলেও ঘরে আসছে একটা পলিথিন। কাচের বোতলে থাকা কোমল পানীয় এখন জায়গা করে নিয়েছে প্লাস্টিক বোতলে। জুস, চিপস, বিস্কুট, মসলা, প্রসাধনী সবই এখন প্লাস্টিকে মোড়া। চায়ের দোকান থেকে কাচের কাপ সরিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে প্লাস্টিকের কাপ। এমনকি পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহার হচ্ছে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের গবেষণার তথ্যানুযায়ী, মুদি দোকানের পণ্য বিক্রিতে ব্যবহৃত প্লাস্টিক ব্যাগ মাটিতে মিশতে সময় লাগে প্রায় ২০ বছর; চা, কফি, জুস তথা কোমল পানীয়র প্লাস্টিক কাপের ক্ষেত্রে সময় লাগে ৫০ বছর; প্লাস্টিকের বোতল প্রকৃতিতে অবিকৃত থাকে প্রায় ৪৫০ বছর। চলতি বছর একটি বেসরকারি সংস্থা ঢাকার চারপাশের নদীতীরের মাটি খুঁড়ে প্রতি টন মাটিতে আধা কেজি থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত প্লাস্টিক পেয়েছে। এর মধ্যে ১৫ বছরের পুরনো প্লাস্টিকও ছিল। কর্ণফুলী নদীতে ২০১৮ সালের ড্রেজিংয়ের সময় ৪৮ লাখ ঘনমিটার মাটি উত্তোলন করা হয়, এর মধ্যে ২২ লাখ ঘনমিটার ছিল পলিথিনযুক্ত বালুমাটি। ২০১২-১৩ সালে ঢাকার চার পাশের নদীর তলদেশের বর্জ্য তুলতে পদক্ষেপ নেয় সরকার। ড্রেজার দিয়ে বর্জ্যযুক্ত মাটি তুলতে গেলে পলিথিনে আটকে ভেঙে যায় ড্রেজারের ব্লেড। ওই সময় গবেষণায় দেখা যায়, নদীর তলদেশ থেকে প্রায় ছয়-সাত ফুট নিচ পর্যন্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য জমে আছে। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন- এসডোর গবেষণায় দেখা যায়, সিলেটের সুরমা নদীতে শুধু ২০২১ সালেই জমে ১৯ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য।

গবেষকরা বলছেন, প্লাস্টিকের মাইক্রোকণাগুলো সহজে মানুষসহ প্রাণীর খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। একটি গবেষণায় দেশের ১৮ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৪৩ শতাংশের পেটে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। গবেষণার জন্য সাভার ও আশুলিয়ার বাজার থেকে সংগৃহীত ওই মাছগুলো বুড়িগঙ্গা, তুরাগ কিংবা আশপাশের খাল থেকে ধরা হয় বলে বিক্রেতারা জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে পানিচক্রের মাধ্যমে আমাদের খাদ্যশৃঙ্খলে প্রবেশ করছে। ন্যানো প্লাস্টিক উদ্ভিদ ও প্রাণীর কোষের ভিতর অবস্থিত ডিএনএ ও আরএনএ অণুর মধ্যে মিউটেশন ঘটিয়ে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। প্লাস্টিক অপচনশীল পদার্থ হওয়ায় পুনঃচক্রায়ন না হওয়া পর্যন্ত এটি পরিবেশে বিদ্যমান থাকে। মাটিতে পলিথিন মিশে থাকায় বর্ষাকালে পানি ভূগর্ভে যেতে পারছে না। এতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, যা কৃষিতে সেচের জন্য হুমকি। এ ছাড়া ক্যান্সার, লিভারের সমস্যাসহ নানা রোগ হচ্ছে।

নিষিদ্ধ করার পরও পলিথিনের ব্যবহার বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক (বর্জ্য ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবস্থাপনা) ড. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, পলিথিনও অবৈধ, ফ্যাক্টরিও অবৈধ। আমরা সীমিত জনবল দিয়ে যতটুকু পারছি অভিযান চালাচ্ছি। জেল-জরিমানা করছি।

দূষণ প্রতিরোধে জরুরি রাজনৈতিক অঙ্গীকার

জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে দিতে পারে

পলিথিন বন্ধ না হওয়ার পেছনে দুর্নীতি

বছরে আর্থিক ক্ষতি লক্ষাধিক কোটি টাকা

 

সর্বশেষ খবর