মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা
রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র

জ্বালানি আসবে সেপ্টেম্বরে

জিন্নাতুন নূর

আসছে সেপ্টেম্বরেই পারমাণবিক জ্বালানি তথা ইউরেনিয়ামের মালিক হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই জ্বালানি আমদানির মধ্য দিয়ে রূপপুর প্রকল্প পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উন্নীত হবে। সেপ্টেম্বরে আসছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ব্যাচ জ্বালানি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের যৌথ সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আগামী বছরের মাঝামাঝি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসবে। এ ছাড়াও প্রকল্পটি নির্মাণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংগঠন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক সংস্থা রোসাটমের মহাপরিচালক (ডিজি) অ্যালেক্সি লিখাচেভ গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। তিনিও প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পারমাণবিক জ্বালানি আগামী সেপ্টেম্বরেই বাংলাদেশে আসবে। এ সময় আলেক্সি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উদ্বোধন অনুষ্ঠান আয়োজন নিয়েও কথা বলেন।

জানা যায়, প্রকল্পটির কাজের সার্বিক অগ্রগতির বিষয়টি মনিটরিং করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের প্রথম ইউনিটে জ্বালানি স্থাপন কাজের উদ্বোধন করবেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান জানান, প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতির পাশাপাশি অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকতে পারেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এরই মধ্যে রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পারমাণবিক জ্বালানি আমদানি, পরিবহন ও সংরক্ষণের অনুমোদন পেয়েছে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ও রাশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী শর্ত পূরণ করায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বিএইআরএ) বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনকে পারমাণবিক জ্বালানি আমদানি ও সংরক্ষণের লাইন্সেস দিয়েছে। আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পারমাণবিক জ্বালানি পরিবহনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে রাশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানকে। এর ফলে আগামী সেপ্টেম্বরে দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জ্বালানি আমদানিতে আর কোনো বাধা নেই। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, পারমাণবিক এই জ্বালানি আমদানি ও সংরক্ষণ সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে পরমাণু শক্তির পরিচালক হিসেবে আন্তর্জাতিক নিউক্লিয়ার ক্লাবে যুক্ত হবে। প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, বিশেষ বিমানে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে এ জ্বালানি বাংলাদেশে আমদানির পর তা রূপপুরে পৌঁছানো হবে। এরই মধ্যে আমদানি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিমান পরিবহন চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। পারমাণবিক জ্বালানি সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় দলিল অনুমোদনের পাশাপাশি এই কাজের সঙ্গে যে বা যারা যুক্ত এমন জনবল নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়েছে। পারমাণবিক কেন্দ্রে জ্বালানি পৌঁছানোর পর তা হস্তান্তর ও পরিচালনার সময় যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে বিশেষ দল গঠন করা হয়েছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তার মধ্য দিয়েই জ্বালানি বিনিময় ও ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। চূড়ান্ত পর্যায়ে যে কোনো দুর্ঘটনা মোকাবিলায় নির্দেশ ছাড়াই প্রশিক্ষিত বিশেষ দলের কর্মীরা দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারবেন- সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে। রূপপুরে ফিজিক্যাল প্রটেকশন সিস্টেমটি সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ দল তত্ত্বাবধান করছে। পারমাণবিক জ্বালানি সংরক্ষণ ও এ সংশ্লিষ্ট কাজের অংশ হিসেবে ফুয়েল স্টোরেজ, জরুরি কেন্দ্রসহ অন্য অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি পরমাণুর বিকিরণ পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে রূপপুর প্রকল্পে। মাঠপর্যায়ে এই প্রস্তুতিও প্রায় শেষের পথে। পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা অনুযায়ী রূপপুরের বীমার কাজটিও শেষ করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। পারমাণবিক চুল্লিতে ইউরেনিয়াম স্থাপন, প্রথম ইউনিটের ফিজিক্যাল স্টার্টআপ সম্পন্ন, গ্রিড সিক্রোনাইজেশন, পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কাজ শেষ হলেই কমিশনিংয়ের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। প্রথম ইউনিটটি পুরোপুরি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার গাইডলাইন মেনে ধাপে ধাপে মূল কমিশনিং পর্যায়ের কাজের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সঞ্চালন কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সঞ্চালন লাইনের কাজ যথাসময়ে শেষ করতে সমন্বিতভাবে কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। তবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে নদীর অংশে সঞ্চালন লাইন নির্মাণে অগ্রগতি কম।

রূপপুর প্রকল্পের পরিচালক ড. শৌকত আকবর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইউরেনিয়াম আসার পরও বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যাপার আছে। এই ধাপগুলো অতিক্রম করার পর কেন্দ্রটি উৎপাদনে যাবে। ইউরেনিয়াম আসার পর আমরা রিয়্যাক্টর সিস্টেমের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রমের পরীক্ষা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইউরেনিয়ামের সঙ্গে ডামি ফুয়েলও আসছে। প্রথমে ডামি ফুয়েল দিয়ে রিয়্যাক্টর চালিয়ে দেখা হবে সব ঠিক আছে কি না। সব ঠিক থাকলে তারপর ইউরেনিয়াম দেওয়া হবে। এখন আমরা নিউক্লিয়ার সিস্টেমের যন্ত্রপাতি পরীক্ষা শুরু করেছি। একটি দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম যাওয়ার অর্থ হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ অপারেশন ইউনিটে উন্নীত হয়েছে। আর এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি পরীক্ষা পার হয়ে আসতে হচ্ছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য যে প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশ তার রপ্তানি কন্ট্রোল নীতি অনুসারে আমার দেশের সব সেফটি সিকিউরিটি নিশ্চিত আছে কি না তা নিশ্চিত হওয়ার পরই ইউরেনিয়াম দেশে আসবে। এ জন্য আইইএই-এর সম্মতি লাগবে। এই জ্বালানির জন্য আমাদের সক্ষমতা আছে কি না সেটা আইইএই যাচাই করবে। আমরা সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে অতিক্রম করে এই জ্বালানি আনতে যাচ্ছি। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রথমবারের মতো পারমাণবিক জ্বালানির মালিক হচ্ছে। এই জ্বালানি আমদানির মধ্য দিয়ে রূপপুর বিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্প পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উন্নীত হবে। সেপ্টেম্বরে আসবে প্রথম ব্যাচ জ্বালানি। প্রসঙ্গত, ১ লাখ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাশিয়ার সহযোগিতায় বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে পাবনার রূপপুরে। সেখানে দুটি ইউনিটে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট করে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এই নির্মাণ ব্যয়ের ১০ শতাংশের অর্থায়ন করছে সরকার। বাকি ৯০ শতাংশ রাশিয়া ঋণ হিসেবে দিচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির মেয়াদ হবে ৬০ বছর। পরে তা আরও ২০ বছর বাড়ানো যাবে।

 

সর্বশেষ খবর