বৃহস্পতিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিপজ্জনক ই- বর্জ্যের ভাগাড়

বছরে দেশে জমছে প্রায় ৩০ লাখ টন ই-বর্জ্য। ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশে। সিসা, পারদ, তামা, ক্যাডমিয়াম ক্রোমিয়াম, আর্সেনিকসহ নানা ক্ষতিকর ভারী ধাতু ও রাসায়নিক দূষিত করছে মাটি, পানি ও বায়ু। ছড়াচ্ছে ক্ষতিকর রেডিয়েশন। বাড়াচ্ছে নানা রোগ

শামীম আহমেদ

বিপজ্জনক ই- বর্জ্যের  ভাগাড়

মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন ভারী ধাতু ও রাসায়নিকযুক্ত বিপজ্জনক ই-বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে দেশ। প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতার মধ্যেই নতুন ঝুঁকি হিসেবে চোখ রাঙাচ্ছে বাতিল ইলেকট্রনিক পণ্য থেকে সৃষ্ট এ আবর্জনা। গবেষণার তথ্যানুযায়ী, বছরে দেশে জমছে প্রায় ৩০ লাখ টন ই-বর্জ্য। বিপজ্জনক এ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না থাকায় অধিকাংশের জায়গা হচ্ছে ময়লার ভাগাড়ে। ছড়িয়ে পড়ছে পরিবেশে। এসব বর্জ্যে থাকা সিসা, পারদ, তামা, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিকসহ নানা ক্ষতিকর ভারী ধাতু ও রাসায়নিক দূষিত করছে মাটি, পানি ও বায়ু। ছড়াচ্ছে ক্ষতিকর রেডিয়েশন। বাড়াচ্ছে ফুসফুস ক্যান্সারসহ কিডনি, যকৃৎ, স্নায়ুতন্ত্র, হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কের নানা রোগ। ই-বর্জ্যের ঝুঁকি কমাতে সরকার ২০২১ সালে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা করলেও এর বাস্তবায়ন আলোর মুখ দেখেনি। তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর দেশে নষ্ট হচ্ছে প্রায় ২ লাখ ৯৬ হাজার ৩০২টি টেলিভিশন। এ থেকে সৃষ্টি হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার টন ই-বর্জ্য। নষ্ট বা মডেল পরিবর্তন করতে গিয়ে বাতিল হচ্ছে কয়েক কোটি মোবাইল ফোন। শুধু স্মার্ট ডিভাইস থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে সাড়ে ১০ লাখ টন ই-বর্জ্য। প্রতিদিনই বাতিলের খাতায় যুক্ত হচ্ছে ফ্রিজ, ওভেন, ব্যাটারি, কম্পিউটার, সোলার প্যানেল, চার্জারসহ অগণিত ইলেকট্রনিক পণ্য। প্রতি বছর এ বর্জ্য বাড়ছে ৩০ শতাংশ হারে। গত জুনে এক অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে এসব তথ্য দেন কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের স্কুল অব সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিন অধ্যাপক ড. সৈয়দ আখতার হোসেন। এদিকে ২০১৮ সালে পরিবেশ অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে বছরে ৪ লাখ টন ই-বর্জ্য জমা হয়। এর মধ্যে কেবল ৩ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ বা রিসাইক্লিং শিল্পে ব্যবহার করা হয়। বাকি ৯৭ শতাংশের ঠাঁই হয় ভাগাড়ে। অর্থাৎ, পাঁচ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে বার্ষিক ই-বর্জ্যরে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় আট গুণ। এ ব্যাপারে পরিবেশবিদ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ই-বর্জ্যরে মধ্যে ক্ষতিকর নানা ধরনের ভারী ধাতু থাকে। এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কথাও বলা আছে। এ জন্য কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আইন করা হয়েছে। কিন্তু, এর বাস্তবায়ন দেখছি না। মূলত, আমরা আইন বানাই, নীতিমালা করি। কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো বিদেশিদের পরামর্শে হয়। আমাদের প্রেক্ষাপটে আইনটি বাস্তবায়নযোগ্য হয় না। ব্যাটারিতে ক্ষতিকর লেড আছে। এটার রিসাইকেল নিয়ে আইন করার সময় ব্যাটারি উৎপাদনকারীদের মতামত নিতে হবে। অন্যথায় আইনটি প্রয়োগযোগ্য নাও হতে পারে। একটা আইন করে বাস্তবায়ন না করতে পারলে লাভ কী? বাংলাদেশে চীনারা ই-বর্জ্য রিসাইকেল কারখানা করেছে। তারা হয়তো দামিটা নিয়ে যাচ্ছে, কম দামিটা ফেলে যাচ্ছে। আমাদেরই এ বর্জ্য রিসাইকেল করতে হবে। ই-বর্জ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভয়েসের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ বলেন, ভোগবাদী মানসিকতা ও রিসাইকেল না হওয়ায় বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ই-বর্জ্য। মানুষ প্রয়োজন না হলেও মোবাইল, টেলিভিশন বদল করছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্যও ই-বর্জ্য দায়ী। অথচ, এখানে এটা নিয়ে কারও কোনো ভাবনাই নেই। পরিবেশ অধিদফতর একটা আইন করেছে, তা কোম্পানিগুলোও জানে না, জনগণও জানে না। অন্য কোনো এনজিও বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এটা নিয়ে কথাও বলছে না। আইনটি হওয়ার পর আমরা একটা গবেষণা করেছিলাম। তাতে নারায়ণগঞ্জে একটা ফ্যাক্টরি ছাড়া অন্য কোথাও ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে দেখিনি। বিষয়টা নিয়ে এখনি উদ্যোগ না নিলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ই-বর্জ্যরে ভয়বহতা বিবেচনায় ১৯৮৯ সালের ব্যাসেল কনভেনশনে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে- এক দেশের অপরিশোধিত এবং ক্ষতিকর ইলেকট্রনিক বর্জ্য অন্য দেশে ফেলা যাবে না। তবে এটা রিসাইকেল করা ব্যয়বহুল হওয়ায় উন্নত দেশগুলো প্রযুক্তিগত ব্যবধান কমানোর নামে অনুদান হিসেবে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোয় পুরনো ইলেকট্রনিক পণ্যগুলো পাঠিয়ে দেয়।

এগুলো অল্প দিনের মধ্যেই বর্জ্যে পরিণত হয়। বাংলাদেশেও এসব পণ্য সেকেন্ডহ্যান্ড বা রিফার্বিস পণ্য হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। আবার কম দামের মানহীন ইলেকট্রনিক পণ্যও আসছে, যেগুলো খুব দ্রুত নষ্ট হচ্ছে। অনেক দেশে ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই এক্সচেঞ্জ অফারের মাধ্যমে পুরনো ডিভাইস সংগ্রহ করে রিসাইকেল করে। বাংলাদেশে এটা নেই বললে চলে। ই-বর্জ্য আলাদাভাবে রাখার জন্য প্রচারণা বা এটা সংগ্রহের ব্যবস্থাও নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ই-বর্জ্যে পারদ, সিসা, সোনা, রূপা, তামাসহ অন্তত ১৭ ধরনের ধাতু থাকে। থাকে প্লাস্টিক ও বিভিন্ন রাসায়নিক। এগুলো পরিবেশ ও জীবজগতের জন্য যেমন ভয়াবহ, তেমনি রিসাইকেল করতে পারলে এটা শিল্প হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। ১ কোটি টন ই-বর্জ্য রিসাইকেল করে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। অথচ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে আমাদের দেশে তিন-চারটা বর্জ্য রিসাইকেলিং কারখানা গড়ে উঠলেও পর্যাপ্ত কাঁচামালের অভাবে চালাতে পারছে না।

সর্বশেষ খবর