বৃহস্পতিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

আত্মহত্যার রহস্য খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এলো দুই খুনের তথ্য

নিজস্ব প্রতিবেদক

আত্মহত্যার রহস্য খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এলো দুই খুনের তথ্য

প্রায় ছয় বছর আগে রাজধানীর কদমতলীর একটি প্রেস থেকে সোহেল নামে এক কর্মচারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে সময় নিখোঁজ ছিলেন তার প্রতিবেশী চাচা ইকবাল। তদন্তসংশ্লিষ্টরা ওই প্রেসের অন্য কর্মচারীদের কাছ থেকে জানতে পারেন, সোহেলকে খুনের পর পালিয়েছেন ইকবাল।

পাঁচ দিন পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বরপা এলাকার একটি মিলের পাশে গাছের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ইকবালের লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় রূপগঞ্জ থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়। কদমতলী থানা পুলিশ সোহেল খুনে ইকবালকেই সন্দেহ করছিল। আর ইকবালের আত্মহত্যার তথ্য পেয়ে তারা আদালতে সোহেল হত্যা মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

এদিকে ইকবালের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে চিকিৎসক জানান, গাছে ঝোলার আগেই তিনি খুন হয়ে থাকতে পারেন। প্রায় এক বছর রহস্য উদ্ঘাটনে তদন্ত করে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ। পরে পুলিশ সদর দফতরের মাধ্যমে তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সংস্থাটির তদন্তে বেরিয়ে আসে, ইকবাল আর তার ভাতিজা সোহেলকে একই দিন খুন করা হয়। আর প্রেসের অন্য কর্মচারীরা এর সঙ্গে জড়িত।

গতকাল দুপুর ১২টায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ জোড়া খুনের রহস্য উদ্ঘাটনের বিস্তারিত তুলে ধরেন সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার। সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার ঘুনিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সোহেল ও তার প্রতিবেশী চাচা ইকবাল হোসেন কদমতলীর কথা এন্টারপ্রাইজ প্রেসে কাজ করতেন। প্রেসের কর্মচারীরা দোতলায়ই থাকতেন। ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর প্রেসের এক কর্মচারী ফোনকল করে জানান, রাত ৩টার দিকে সোহেলকে লোহার রড দিয়ে মাথায় আঘাত করে ইকবাল পালিয়ে গেছেন। গুরুতর অবস্থায় প্রেসের মালিক ও কর্মচারীরা সোহেলকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যান। এ ঘটনায় সোহেলের ছোট ভাই সাইদুর রহমান বাদী হয়ে ইকবালের (৫৫) নামে কদমতলী থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। পরে ৮ নভেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোহেল মারা যান। প্রেস কর্মচারীরা থানা পুলিশ ও নিহতের স্বজনদের জানিয়েছেন, ৬ নভেম্বর রাত ৩টায় চাচা ইকবাল নামাজ পড়তে ওঠেন। এ সময় রুমের লাইট জ্বালানোকে কেন্দ্র করে চাচা-ভাতিজার দ্বন্দ্ব হয়। একপর্যায়ে লোহার রড দিয়ে ইকবাল সোহেলকে গুরুতর আহত করে পালিয়ে যান। এর পাঁচ দিন পর রূপগঞ্জের বরপার বিক্রমপুর স্টিল মিলের পাশে গাছের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় ইকবালের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনাকে প্রেসের কর্মচারীরা প্রচার করেন নিজের অপরাধে অনুতপ্ত হয়ে ইকবাল আত্মহত্যা করেছেন। এ ঘটনায় রূপগঞ্জ থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা করে পুলিশ।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কদমতলী থানায় করা মামলার একমাত্র আসামি ইকবালের লাশ উদ্ধার হওয়ায় ২০১৮ সালে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এদিকে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে ইকবালের লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি হত্যা উল্লেখ করায় প্রেসের ১০ কর্মচারীর বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন ইকবালের স্ত্রী পারভীন বেগম। মামলাটি রূপগঞ্জ থানা পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে ছয় প্রেস কর্মচারীকে গ্রেফতার করে। কিন্তু কোনো ধরনের তথ্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হন তারা। পরে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ইকবাল হত্যা মামলার তদন্তে নেমে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে লাশ নিয়ে যাওয়া গাড়ির খোঁজে নামেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় গাড়ি ও সেই সময়ে গাড়ির চালক নুর আলম ও তার মোবাইল নম্বর শনাক্ত করা হয়। কিন্তু নুর আলমের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটি অন্য এক চালকের। নুর আলম নিজেকে আড়াল করতে অন্যের নম্বর ব্যবহার করেন। নুর আলমকে আটকের পর পিবিআইকে জানান, ২০১৭ সালে তিনি বাদল মিয়ার পিকআপ ভ্যান চালাতেন। নুর আলম ও বাদল লাশ গুম করার কথা স্বীকার করেন। তারা জানান, প্রেসের কর্মচারীরাই ইকবালকে হত্যা করেন। ইকবাল ছিলেন পরহেজগার ও নামাজি ব্যক্তি। তিনি নামাজের জন্য ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। আর কর্মচারীরা রাত জেগে মধ্যরাতে ঘুমাতে যেতেন। এ সময় রুমের লাইট জ্বালাতেন ইকবাল। আর এ লাইট জ্বালানো নিয়ে অন্য কর্মচারীদের সঙ্গে প্রায়ই ইকবালের বাগ্বিতণ্ডা হতো। ঘটনার দিন প্রেস কর্মচারী আবদুর রহমানের সঙ্গে ইকবালের ঝগড়া, হাতাহাতি হয়। এ সময় অন্য কর্মচারীরাও ইকবালকে মারধর করেন। দীর্ঘদিনের ক্ষোভের ফলে তারা সবাই মিলে ইকবালকে মারধর ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। তখন সোহেল ইকবালকে বাঁচাতে গেলে তারা তাকেও লোহার রড দিয়ে এলোপাথাড়ি মারধর করে আহত করেন। এরপর জামাল তার পূর্বপরিচিত পিকআপ ভ্যান চালক নুর আলম ও গাড়ির মালিক বাদলের সঙ্গে কথা বলে ২০ হাজার টাকায় পিকআপ ভ্যান ভাড়া করেন। বাদল ও নুর আলম পিকআপ ভ্যানটি প্রেসে নিয়ে আসেন। এক দিন পর ইকবালের লাশ পিকআপ ভ্যানে করে রূপগঞ্জের বরপায় নিয়ে লাশের গলায় গামছা পেঁচিয়ে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখেন। পিবিআই বলছে, দুটি মামলায়ই তদন্তে হত্যা ও লাশ গুমের সঙ্গে মোট ১৪ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তবে হত্যায় জড়িত এক আসামির মৃত্যু হয়েছে এবং দুজন পলাতক। দুটি মামলায়ই দ্রুত অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।

সর্বশেষ খবর