বৃহস্পতিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

পৌনে তিন শ বছরের বাকরখানি

মোস্তফা মতিহার

পৌনে তিন শ বছরের বাকরখানি

ঢাকার ইতিহাসে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ দখল করে আছে বাকরখানি। এটি হচ্ছে ময়দা দিয়ে তৈরি বিস্কুটজাতীয় এক প্রকার খাবার। পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের সকালের নাশতা হিসেবে বাকরখানি অতি প্রিয় একটি খাবার। ময়দার খামির থেকে বিস্কুট বানিয়ে তা মচমচে বা খাস্তা করে ভেজে তৈরি করা হয় বাকরখানি। ছোটবড় বিভিন্ন আকারের বাকরখানি পাওয়া যায় পুরান ঢাকায়। বাকরখানিতে সাধারণত ময়দার সঙ্গে স্বাদবর্ধক আর কিছু দেওয়া হয় না। তবে চিনি দেওয়া বাকরখানিও একেবারে বিরল নয়। এটি এতই প্রসিদ্ধ ছিল যে, একসময় উপহার হিসেবেও স্বজন আর প্রতিবেশীদের বাড়িতে পাঠানো হতো।

বাকরখানির নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঢাকার ইতিহাস। ঢাকার নায়েব নাজিম মীর লুৎফুল্লাহ ওরফে দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খাঁর জামাতা ছিলেন মির্জা আগা বাকের। নবাব সিরাজদ্দৌলার অনুরক্ত বাকের ছিলেন বুজর্গ উমেদপুর ও সালিমাবাদ নামে দুটি পরগনার জমিদার। আগা সাদিক ছিলেন তাঁর পুত্র। জনশ্রুতি রয়েছে, আগা বাকের ও তাঁর স্ত্রী খানি বেগমের নামানুসারেই মচমচে এর নাম রাখা হয় ‘বাকরখানি’। নবাব পরিবারের বাবুর্চিরাই এ বাকরখানির আবিষ্কারক। স্যার সলিমুল্লাহ থেকে শুরু করে নবাব ও নবাব পরিবারের সদস্যরা ছিলেন বাকরখানির ভক্ত। সকালের নাশতায় মাংস ও বাকরখানি না হলে চলত না তাঁদের। প্রথমে নবাব পরিবারের প্রিয় খাবার হিসেবে থাকলেও পরে এর বিস্তৃতি ঘটে এলাকাবাসীর মধ্যে। সেই থেকে আজও আছে বাকরখানির চাহিদা। পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় তৈরি হয় বাকরখানি। সেখানে তা শুকারুটি (শুকনো) নামেও পরিচিত। মূলত আফগানিস্তানই বাকরখানির উৎপত্তিস্থল। আফগানিস্তান ও রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এখনো এর প্রচলন রয়েছে। আর মুঘল শাসনামলে লালবাগ কেল্লার কাছে ঢাকায় সর্বপ্রথম বাকরখানির দোকান গড়ে ওঠে। সেই থেকে বাকরখানির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক প্রায় পৌনে তিন শ বছরের। লালবাগ কেল্লার কাছে বাকরখানির পথচলা শুরু হয়ে এর বিচরণ এখন পুরান ঢাকার নাজিরাবাজার, চানখাঁরপুল, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, আলাউদ্দিন রোড, নাজিমউদ্দিন রোড, সাতরওজা, আগামসিহ লেনসহ বিভিন্ন এলাকায়। বাকরখানি এখনো এসব এলাকার বাসিন্দাদের সকালের নাশতার প্রধান অনুষঙ্গ। আধুনিকতার এই সময়ে নানা রকমের ফাস্টফুডের ভিড়ে বাকরখানি এখনো দাপটের সঙ্গে টিকে আছে স্বমহিমায়। পুরান ঢাকার বাকরখানির দোকানগুলোর সামনে ভিড়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাকরখানির প্রতি ভোজনবিলাসীদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। প্রায় পৌনে তিন শ বছর জনপ্রিয়তা ধরে রাখা বাকরখানির স্বাদ আস্বাদনে রাজধানীর দূরদূরান্ত থেকে প্রতিদিনই পুরান ঢাকায় ছুটে আসছেন বাকরখানিপ্রেমীরা। নাজিমউদ্দিন রোডের প্রসিদ্ধ নাসু অ্যান্ড ফারুক বাকরখানি দোকান। স্বাদে ও মানে এ দোকানটির বাকরখানি শীর্ষস্থান দখল করে আছে বলে জানান এলাকার বাসিন্দারা। দোকানের কর্মচারী নজরুল ইসলাম জানান, মিষ্টি, মিষ্টিছাড়া, পনিরের ও ঘিয়ের- এ চার ধরনের বাকরখানি তাদের দোকানে পাওয়া যায়। আর স্বাদ ও মান ভেদে তাদের দোকানে ১৮০ থেকে শুরু করে ৩০০ টাকা প্রতি কেজি বাকরখানি পাওয়া যায়। এ দোকানের রাহাত ইসলাম জানান, দুই শিফটে তারা ১২ জন শ্রমিক কাজ করেন। প্রতিদিন এ দোকানে ৭০ থেকে ৮০ কেজি বাকরখানি বিক্রি হয়। বিক্রি ও ক্রেতাসমাগমে তারা সন্তুষ্ট বলেও জানান।

নাসু অ্যান্ড ফারুক বাকরখানি দোকানের সামনে কথা হয় রাজধানীর উত্তরা থেকে আগত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবিরের সঙ্গে। তিনি জানান, পুরান ঢাকার বাকরখানি তার মায়ের খুবই পছন্দের খাবার। মাসে একবার হলেও তিনি এ দোকান থেকে বাকরখানি কিনে নিয়ে যান।

 ‘চায়ের সঙ্গে ভিজিয়ে বাকরখানি খুবই মজাদার খাবার’ উল্লেখ করে শান্তিনগর থেকে আগত মনিরুল ইসলাম জানান, চায়ের সঙ্গে তিনি প্রতিদিনই বাকরখানি খেয়ে থাকেন। তার দেখাদেখি পরিবারের অন্য সদস্যরাও বাকরখানিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে পুরাতন জেলখানার ঢালের সাতরওজা এলাকার বাকরখানি দোকানের মালিক আতিকুল ইসলাম বলেন, পূর্বপুরুষের ব্যবসা বলে ঐতিহ্যবাহী এ দোকানটি ধরে রেখেছেন। জিনিসপত্রের দাম বেশি হওয়ায় আগের মতো লাভের মুখ দেখতে পান না। পাঁচজন কর্মচারীর মজুরি ও আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই বলেও জানান তিনি। বাকরখানির সঙ্গে ঢাকার ঐতিহ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সাতরওজা এলাকার সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধা আঙ্গুরি জাহান জানান, শৈশব থেকেই তাদের নাশতার পারিবারিক ঐতিহ্য বাকরখানি। এখনো প্রতিদিন বাকরখানি ছাড়া তাদের বাসার নাশতা অসম্পূর্ণ থাকে। আধুনিকতার জাঁতাকলে নানা রকমের লোভনীয় ফাস্টফুডের ভিড়ে ঐতিহ্যবাহী ঢাকাইয়া খাবার বাকরখানি এখনো সমাদৃত রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষের কাছে। ঢাকার নবাব, মসলিন, কালীবাড়ী মোড়ের বাতিসহ অনেক ঐতিহ্যের বিলুপ্তি ঘটলেও বাকরখানি টিকে আছে দেশের মানুষের ভালোবাসায়।

সর্বশেষ খবর