বুধবার, ৯ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

ডুবেছে সড়ক বাড়ি শহর

♦ বিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ♦ পানির নিচে বান্দরবান খাগড়াছড়িসহ পাহাড়ি এলাকা ♦ জোয়ারে নিখোঁজ চারজন ♦ চট্টগ্রামসহ চার জেলায় বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

প্রতিদিন ডেস্ক

ডুবেছে সড়ক বাড়ি শহর

টানা বর্ষণে ও জোয়ারের পানিতে তলিয়েছে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া -বাংলাদেশ প্রতিদিন

চট্টগ্রাম মহানগর টানা পাঁচ দিন পানির নিচে। অচল চট্টগ্রাম। প্লাবিত হয়েছে উপজেলা। পানির কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে সাময়িক বন্ধ ছিল যান চলাচল। সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির। গত এক সপ্তাহ ধরে ৬৬৪ মিলিমিটারের রেকর্ড বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির পানিতে নিখোঁজের পর মরদেহ উদ্ধার করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর। নিখোঁজ এক ব্যবসায়ী ও এক কৃষক। গতকালও দিনভর কখনো থেমে কখনো মুষলধারে বৃষ্টি হয়। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামে চলতি আগস্ট মাসের সাত দিনে ৬৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।

এদিকে টানা বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা ও পাহাড়ি ঢলের কারণে জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার সরকারি-বেসরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আজ বুধবার ও কাল বৃহস্পতিবার বন্ধ ঘোষণা করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)।

চট্টগ্রামে ডুবেছে রেললাইন  -বাংলাদেশ প্রতিদিন

এদিকে চট্টগ্রামে গত পাঁচ দিনের টানা ভারী বর্ষণের কারণে ব্যাহত হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম। বর্ষণের কারণে সাগর উত্তাল থাকায় বহির্নোঙরে যেতে পারছে না লাইটার জাহাজ। যার প্রভাব পড়েছে বন্দরের সার্বিক কার্যক্রমে। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘ভারী বর্ষণের কারণে বন্দরের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সাগর উত্তাল থাকায় বহির্নোঙরে স্বাভাবিকভাবে পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল সকালে চকবাজার, বাকলিয়া, বাদুড়তলা, আগ্রাবাদ, মুরাদপুর, আতুরার ডিপোসহ নগরের বেশির ভাগ নিম্ন এলাকা গত পাঁচ দিন ধরে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে আছে। বাসাবাড়িতে ঢুকে গেছে পানি। ডুবে গেছে বাসার নিচতলার পানির মোটর। এ কারণে ভবনে পানি তুলতে পারছেন না অনেকেই। সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির। সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলার বেশির ভাগ এলাকা প্লাবিত। সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলায় সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী বন্যাকবলিত এলাকায় প্রয়োজনীয় সহায়তা করছে। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, চট্টগ্রামের সব কটি উপজেলায় বন্যার পানি ওঠে। তবে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলায় বেশি উঠেছে। উপজেলাগুলোয় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ত্রাণ সহায়তা শুরু করা হয়েছে। চন্দনাইশ উপজেলার হাসিমপুর কসাইপাড়া এলাকা, সাতকানিয়ার কেরানিহাট এলাকা, হাসমত আলী শিকদারের দোকান ও লোহাগাড়ার বার আউলিয়া ডিগ্রি কলেজের সামনে দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় তৈরি হয় যানজট।

নিখোঁজ শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার : চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার জনকল্যাণ স্কুল এলাকার বাসিন্দা জুনায়েদুল ইসলাম জারিফ গত সোমবার রাতে বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে নিখোঁজ হন। গতকাল বিকালে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। জারিফ বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অনার্স প্রথমবর্ষের ছাত্র ছিল। সে তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। এদিকে লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের উত্তর আমিরাবাদ চট্টলাপাড়ার বাসিন্দা কৃষক আসহাব মিয়া (৬৫) বন্যার পানিতে ডুবে নিখোঁজ হন। গতকালও তার খোঁজ মিলেনি। অন্যদিকে গত সোমবার সন্ধ্যায় রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের এস এম ইউসুফের বড় ছেলে শাহেদ হোসেন বাবু হালদা নদীর শাখা খালে নিখোঁজ হন। গতকাল বিকাল পর্যন্ত তার খোঁজ মিলেনি।

বিদ্যুৎহীন আট উপজেলা : পানিতে প্লাবিত চট্টগ্রামের আট উপজেলা। ফলে ওইসব উপজেলায় নষ্ট হয়ে গেছে বিদ্যুতের খুঁটি। এসব উপজেলায় বন্ধ রাখা হয় বিদ্যুতের সরবরাহ। বিদ্যুৎহীন উপজেলাগুলো হলো- পটিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, বাঁশখালীর কয়েকটি এলাকা, বোয়ালখালী, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, হাটহাজারী ও আনোয়ারার কিছু এলাকা।

বান্দরবান : ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয় পার্বত্য জেলা বান্দরবান। জেলা সদরের আর্মিপাড়া, ইসলামপুর, গর্জনিয়াপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকাদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে গত রবিবার থেকে মাইকিং করছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। বান্দরবানে খোলা হয়েছে ২০৭টি আশ্রয় কেন্দ্র। পরিস্থিতি মোকাবিলায় মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী। জানা যায়, বন্যার পানির কারণে চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

কক্সবাজারে সড়কে চলছে নৌকা  -বাংলাদেশ প্রতিদিন

কক্সবাজার : কক্সবাজারে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে নতুন করে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গতকাল বিকালে জেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য মতে, কক্সবাজার জেলায় এই পর্যন্ত জেলার নয়টি উপজেলার ৬০টি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। যেখানে দুর্গত মানুষের সংখ্যা ২ লক্ষাধিক উল্লেখ করা হলেও এর সংখ্যা ৫ লাখের কাছাকাছি বলে জানা গেছে। বন্যা পরিস্থিতিতে গতকাল দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে রামুতে পানিতে ডুবে এক শিশু এবং পেকুয়ায় সাপের কামড়ে এক ব্যবসায়ী মারা যান। এর আগে সোমবার পাহাড় ধসে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মা-মেয়ে এবং চকরিয়ায় শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়।

কক্সবাজারের পেকুয়ায় অতিবৃষ্টিতে প্লাবিত পানিবন্দি দুর্গত মানুষের মধ্যে গতকাল জরুরি খাদ্য সহায়তা প্রদান করেছে নৌবাহিনী -আইএসপিআর

গতকাল বিকাল ৫টায় কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশের পাঠানো এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, গতকাল বিকাল পর্যন্ত ৬০ ইউনিয়নের পানিবন্দি থাকার তথ্য জেলা প্রশাসন পেয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার সদরের পাঁচটি, রামুর তিনটি, ঈদগাঁওর পাঁচটি, চকরিয়ার ১৮টি, পেকুয়ার সাতটি, মহেশখালীর পাঁচটি, কুতুবদিয়ার ছয়টি, উখিয়ার পাঁচটি, টেকনাফের ছয়টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এই ৬০ ইউনিয়নের ২ লাখ ১১ হাজারের বেশি মানুষ দুর্গতকবলিত। এই ৯টি উপজেলার ২০৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে সাড়ে ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় নেওয়ার তথ্য রয়েছে।

খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়ি জেলার চেঙ্গী নদী ও দিঘীনালা উপজেলার মাঈনী নদীর পানি বেড়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দিঘীনালা মেরুং-লংগদু সড়ক ডুবে গেছে। এ সড়কে গতকাল সকাল থেকে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। মেরুং ইউনিয়নের একমাত্র বাজারটিও এখন পানির নিচে। জেলা সদর ও দিঘীনালা উপজেলার কবাখালী, মেরুং ও ছয় শতাধিক বাড়িঘর পানিতে প্লাবিত।

ফেনী : ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরামের বন্যাকবলিত এলাকার সংখ্যা বাড়ছে। বাঁধভাঙা স্থান দিয়ে পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। নতুন করে বাঁধের কোনো স্থানে ভাঙন দেখা না দিলেও ভারতের উজান থেকে এখনো ভাঙা স্থান দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। এতে নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, বর্তমানে পানি বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

কৃষি বিভাগ বলছে, বন্যায় ৭০ হেক্টর রোপা আমন, তিন হেক্টর সবজি ও সাড়ে তিন হেক্টর সবজির আবাদ পানির নিচে। পানি নামলে বোঝা যাবে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। গত দুই দিনে পানিবন্দি মানুষ রয়েছে সীমাহীন দুর্ভোগে।

বাগেরহাট : বাগেরহাটে এক সপ্তাহের টানা বৃষ্টিপাত ও নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পানিতে ভাসছে শহর থেকে গ্রাম। জেলা শহরের বেশির ভাগ সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৯০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে মোংলা আবহওয়া অফিস। জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৭ হাজার ৫১০টি পরিবার। তলিয়ে গেছে ১ হাজার ৫৮০টি মাছের ঘের। অবিরাম বৃষ্টিতে চরম বিপাকে পড়েছেন খেটে খাটা খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ।

লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরে টানা তিন দিনের বৃষ্টি ও মেঘনা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে প্রায় ২ হাজার হেক্টর আমন ধান ও শাক-সবজির খেত এখন পানির নিচে। জেলার কমলনগর ও রামগতি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৫০টি কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ও ২৫টি গ্রামীণ পাকা-কাঁচা সড়ক এবং শতাধিক গাছ ভেঙে গেছে। এখন জনপদে ঢুকেছে পানি। এতে জলাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন মানুষ।

নোয়াখালী : নোয়াখালী জেলা শহরের মাইজদী স্টেশনের প্ল্যাটফরমে রেললাইনের ওপর গাছ উপড়ে পড়ে সোনাপুর থেকে ঢাকা রেল যোগাযোগ প্রায় ৮ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর দুপুরে চালু হয়েছে। সোমবার মধ্যরাতের দিকে গাছটি উপড়ে পড়ে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন উপকূলের যাত্রীরা।

 

বন্যার কবলে দেশ

১. টানা বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সাতকানিয়ার কেরানীহাট এলাকার সড়ক ডুবে গেছে ২. বান্দরবান এলাকার ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে ৩. চট্টগ্রামের চন্দনাইশের বিভিন্ন এলাকা ও সড়ক পানিতে ডুবে যাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ ৪. খাগড়াছড়িতে বাড়িঘরে বন্যার পানি ৫. ফেনীর মুহুরী ফুলগাজী ও পরশুরামের তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত    -বাংলাদেশ প্রতিদিন

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর