শিরোনাম
বুধবার, ৯ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

কলকাতার শিশু বিক্রি চক্রের জাল ছড়িয়েছে বাংলাদেশেও

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

শুধু কলকাতা শহর বা ভারতের অন্য কোনো রাজ্য নয়। কলকাতায় চিকিৎসা করতে আসা নিঃসন্তান বাংলাদেশি দম্পতিদের কাছেও মোটা রুপির বিনিময়ে শিশু বিক্রির অভিযোগ উঠেছে কলকাতার শিশুবিক্রি চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে।

কয়েক দিন আগে কলকাতার আনন্দপুর থানায় শিশু বিক্রির একটি অভিযোগ জমা পড়ে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নেমে দফায় দফায় কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম মমতা পাত্র ও তার সহযোগী স্বপ্না সরদার। অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে তদন্ত কর্মকর্তাদের হাতে। সম্প্রতি কলকাতার একটি ‘ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন’ (আইভিএফ) সেন্টারে চিকিৎসা করাতে আসা এক বাংলাদেশি দম্পতি ওই চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে শিশু কিনে নিয়ে গিয়েছেন বলে জানা গেছে। জানা গেছে, ওই বাংলাদেশি নারী তার ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে কলকাতায় ১০ মাস অবস্থান করেন। এরপর মোটা অর্থের বিনিময়ে তার হাতে সন্তান তুলে দেওয়া হয়। ওই দম্পতি কোথা থেকে এসেছিলেন, পাচার হওয়া ওই শিশুর প্রকৃত মা কে, কোথায় চিকিৎসা করা হচ্ছিল সেগুলোই এখন জানার চেষ্টা চলছে। এখনো পর্যন্ত কতজন শিশুকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে জানার চেষ্টা চলছে তাও।

কীভাবে এই চক্রের হদিস সামনে এলো? ৩১ জুলাই আনন্দপুর থানায় ২২ দিন বয়সী একটি সদ্যোজাত কন্যাসন্তানের নিখোঁজের অভিযোগ দায়ের করা হয়। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নেমে ইতোমধ্যে ওই সদ্যোজাত শিশুকে উদ্ধার করার পাশাপাশি একাধিক নারীকে আটক করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম রূপালী মণ্ডল নামে ওই শিশুটির মা ও কল্যাণী গুহ, যার কাছে শিশুটি বিক্রি করা হয়েছে।

পরে নিঃসন্তান ওই নারীই স্বীকার করেন তিনবার আইভিএফ পদ্ধতিতে চেষ্টা করেও সন্তানের জন্ম দিতে পারেননি। এরপর বেহালার একটি আইভিএফ সেন্টারের কর্মীর প্রস্তাবে ৪ লাখ রুপির বিনিময়ে সন্তান পেতে রাজি হন তিনি। আনন্দপুরের বাসিন্দা রূপালী মণ্ডলের সঙ্গে চুক্তি হয় সন্তান প্রসবের পরই ওই বাচ্চা কল্যাণীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হবে। স্বাভাবিকভাবে শিশুবিক্রি চক্রের পেছনে কলকাতা শহরের আইভিএফ সেন্টারগুলোর জড়িত থাকার অভিযোগও একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। বর্তমানে মমতা, স্বপ্নাসহ শিশু বিক্রির ঘটনায় আটক সবাই রয়েছেন পুলিশের হেফাজতে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে, বিভিন্ন আইভিএফ সেন্টার থেকে তারা নিঃসন্তান দম্পতিদের টার্গেট করতেন। যদিও তাদের প্রথম টার্গেট থাকত বাংলাদেশিরা। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে এসব আইভিএফ সেন্টারে বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক নিঃসন্তান দম্পতি চিকিৎসার জন্য আসছেন। তখনই চক্রের সদস্যরা ঠিক করেন বাংলাদেশিদের টার্গেট করতে হবে। এতে মোটা রুপি পাওয়া যাবে। কারণ তাদের ধারণা, যেসব দম্পতি চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ থেকে আসছেন তারা আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট সচ্ছল। অন্যদিকে সেই বাচ্চা একবার বিদেশে চলে গেলে তাকে উদ্ধার করে আনা পুলিশের পক্ষেও অতটা সম্ভব হবে না। এমনকি খুব মসৃণভাবে এ কাজ করার জন্য বাংলাদেশেও এই চক্রের এজেন্টরা আছে বলে ধারণা পুলিশের। তদন্তে এও উঠে এসেছে, যেসব বাংলাদেশি দম্পতি দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা করেও কোনো সন্তান ধারণ করতে না পেরে হতাশ, মূলত তাদের খুঁজে বেড়াতেন মমতা, স্বপ্না বা তাদের সহযোগীরা। সেসব নিঃসন্তান দম্পতির সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে তাদের আশ্বাস দেওয়া হতো যে বাচ্চা পেতে কোনো সমস্যা হবে না। এর জন্য অভিযুক্তরা ওই সব দম্পতির কাছ থেকে মোটা অর্থ চাইতেন। আর যারা তাদের এ প্রস্তাবে রাজি হতেন তাদের বলা হতো ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে এখানে থেকে যেতে। ১০ মাস পর সেই সব নিঃসন্তান দম্পতির হাতে তুলে দেওয়া হতো সন্তান। ওই বাচ্চাকে বাংলাদেশে নিয়ে যেতে যাতে অসুবিধা না হয় তার জন্য নার্সিং হোমের নাম, জন্মের সনদসহ প্রয়োজনীয় ভুয়া নথিও তৈরি করে দেওয়া হতো বলে অভিযোগ। পুলিশের সন্দেহ, শুধু বাংলাদেশেই নয়, শ্রীলঙ্কায়ও এভাবে শিশু বিক্রি করা হয়ে থাকতে পারে। কারণ আইনগতভাবে কোনো বাচ্চাকে দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা থাকার কারণেই অনেক দম্পতি তা এড়িয়ে চলেন। আইভিএফ সেন্টারের কর্মী ছাড়াও কয়েকজন চিকিৎসকও এই শিশুবিক্রি চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন বলে তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রাথমিক অনুমান। সেসব চিকিৎসককে চিহ্নিত করে তদন্তের আওতায় আনা হতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। এমনকি তদন্তকারীরা এও জেনেছেন, শিশুবিক্রির চক্রের সদস্যরা ‘সারোগেটেড মাদার’ অর্থাৎ কোনো নারীর গর্ভ ভাড়া নিতেন। এ ক্ষেত্রে টার্গেট করা হতো গরিব ও দুস্থ নারীদের। কারণ সামান্য অর্থের প্রয়োজনে ওই নারী সন্তানের জন্ম দিতেন। পরে হাতবদল হয়ে মোটা অর্থের বিনিময়ে সেই সন্তান চলে যেত নিঃসন্তান দম্পতির হাতে। অভিযুক্তদের জেরা করে পুলিশ এখন জানার চেষ্টা করছে ঠিক কতজন নারীকে এভাবে অবৈধ ব্যবসায় টেনে আনা হয়েছিল।

 

সর্বশেষ খবর