শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা
আজ বিশ্ব হাতি দিবস

অস্তিত্ব সংকটে ‘মহাবিপন্ন’ হাতি

♦ দেশে বিচরণ করছে দুই শ’রও কম হাতি ♦ খাবার সংকট, আবাসস্থল সংকট, স্থাপনা নির্মাণ ও মানুষের আক্রমণে মৃত্যু

জিন্নাতুন নূর

অস্তিত্ব সংকটে ‘মহাবিপন্ন’ হাতি

চলতি বছরের ১৭ মে রাজধানীর উত্তরার কোটবাড়ি এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় একটি বাচ্চা হাতির করুণ মৃত্যু হয়। এর আগে একই মাসের ৬ মে শেরপুরের ঝিনাইগাতী সীমান্ত এলাকায় আরেকটি বন্যহাতির বাচ্চা বিদ্যুৎপৃষ্টে মারা যায়। ফসল বাঁচাতে জমিতে দেওয়া জিআই তারের বৈদ্যুতিক সংযোগে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হাতিটির মৃত্যু হয়। পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন- যেভাবে বাংলাদেশে একের পর এক ‘মহাবিপন্ন’ তালিকায় থাকা বিশালাকার এই প্রাণীটির মৃত্যু হচ্ছে, তাতে এরই মধ্যে হাতির অস্তিত্ব সংকটে পড়তে বসেছে। আশার কথা হচ্ছে, সরকার এই প্রাণীটি রক্ষায় ‘হাতি সংরক্ষণ প্রকল্প’ পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। এটি পাস হলে বিপন্ন প্রাণীটি রক্ষায় সংশ্লিষ্টরা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবেন বলে বন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে। এ অবস্থায় আজ সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও পালিত হবে বিশ্ব হাতি দিবস। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ইউনিয়নের (আইইউসিএন) তথ্য বলছে, বিশ্বজুড়ে হাতি ‘বিপন্ন’ তালিকায় থাকলেও বাংলাদেশে এটি ‘মহাবিপন্ন’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। নির্বিচারে হাতি হত্যা এর মূল কারণ। ১৯৮৬ সালে হাতিকে লাল তালিকাভুক্ত করে আইইউসিএন। সংস্থাটির ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী- বাংলাদেশের বনাঞ্চলে ২৮৬টি এবং বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন চিড়িয়াখানা বা সাফারি পার্কে আরও ৯৬টি হাতি রয়েছে। সংস্থাটির ২০১৬ সালের সমীক্ষা বলছে, সে বছর হাতির সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২৬৮টিতে। বর্তমানে দেশে হাতির সংখ্যা ২০০টিরও কম। গত ছয় বছরে প্রায় ৬৮টি হাতি মারা গেছে। বন বিভাগের তথ্য বলছে, ২০০৪ থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত গত ১৭ বছরে মানুষের হাতে ১১৮টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। আর বেসরকারি তথ্যে, ২০২১-২২ সালে বিভিন্ন ঘটনায় ৩৪টি হাতি মারা গেছে। যদিও বন বিভাগের রেকর্ডে এ সংখ্যা ১৬টি। অন্যদিকে গত পাঁচ বছরে সারা দেশে কমপক্ষে ৫০টি হাতি হত্যা করা হয়েছে বলে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা জানিয়েছে। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্যে, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় ২৫টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২১টি হাতিকে মানুষ হত্যা করেছে। মূলত মানুষ ফসল রক্ষা ও হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচতে নির্বিচারে হাতি হত্যা করছে। এ ছাড়া হাতির আবাসস্থল সংকোচন, বন উজাড় করে কৃষিকাজ, রেললাইন, ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, হাতি চলাচলের পথ কমে যাওয়া এবং হাতির খাদ্য সংকটসহ বিভিন্ন কারণে হাতির মৃত্যু হচ্ছে। বন দখলে রাখার জন্য বন দখলকারী একটি চক্র জমির চারপাশে বিদ্যুতের তার দিয়ে বিদ্যুতায়িত করেও হাতি হত্যা করছে। বিশেষ করে শেরপুরে এভাবে বেশি হাতি হত্যা করা হচ্ছে। এ ছাড়া হাতির মৃত্যুর অন্য কারণ হচ্ছে-অসুস্থতা, বয়সজনিত কারণ, খাদ্যে বিষক্রিয়া ও পিটিয়ে হত্যা। কিছু ক্ষেত্রে চোরা শিকারিরা দাঁতসহ দেহাংশের লোভেও প্রাণীটিকে হত্যা করছে। বাংলাদেশে সাধারণত ‘এশিয়ান এলিফ্যান্ট’ প্রজাতির হাতি দেখা যায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম এলিফাস ম্যাক্সিমাস। দেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট ও ময়মনসিংহের পাহাড়ি অঞ্চলে এই হাতিদের বিচরণ করতে দেখা যায়। হাতি রক্ষায় ‘হাতি সংরক্ষণ প্রকল্প’ নামে ৪৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করে এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এর আওতায় হাতির সংখ্যা জরিপ, আবাসস্থল উন্নয়ন ও হাতির খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে এর খাদ্য উপযোগী বাগান সৃজন, নিরাপদ পানি সরবরাহে জলাধার তৈরি, হাতি উদ্ধার কেন্দ্র ও হাতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণে টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। তবে দেশে হাতি সংরক্ষণে আইন থাকলেও এর বাস্তবায়ন না থাকায় মহাবিপন্ন এই প্রাণীর অস্তিত্ব সংকটে পড়তে বসেছে। হাতি হত্যায় মামলা হলেও এসব মামলার নিষ্পত্তি হয় না। কোনো ব্যক্তি হাতি হত্যা করেছে বলে প্রমাণিত হলে তিনি জামিন পাবেন না এবং অপরাধীকে সর্বনিম্ন দুই বছর এবং সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ১ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দেওয়া হবে। একই অপরাধ আবারও করলে সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে কেউ যদি হাতির হামলার শিকার হন, তাহলে জীবণ রক্ষার্থে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না। আবার হাতির আক্রমণে হতাহতদের জন্য সরকার ক্ষতিপূরণও দিয়ে থাকে। বন বিভাগের তথ্যে, হাতি রক্ষায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে বন বিভাগের ২৭টি ‘এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম’ কাজ করছে। স্থানীয় গ্রামবাসীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এ টিম গঠন করা হয়েছে। লোকালয়ে চলে আসা হাতিকে বনে ফিরিয়ে দেওয়া তাদের কাজ। বন সংরক্ষক (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল) ইমরান আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় কমানোর কারণে এখনো হাতি সংরক্ষণ প্রকল্পটি পাস হয়নি। কিন্তু এর গুরুত্ব তুলে ধরে আমরা মন্ত্রণালয় থেকে আবারও পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটি পাঠিয়েছি। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, তারপর ওপর রোহিঙ্গাদের চাপ আছে। বিশ্বের অনেক দেশে হাতির আবাসস্থল না থাকলেও বাংলাদেশ এলিফ্যান্ট রেঞ্জ হওয়ার পরও আমরা হাতির আবাসস্থল ধ্বংস করছি। বনের জমিতেই সব স্থাপনা নির্মাণ করায় হাতির আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে আসছে। মনে রাখতে হবে হাতি মাংসাশী প্রাণী নয়, তাকে বিরক্ত করলে, আবাসস্থল ধ্বংস করলে তখন উদভ্রান্ত হয়ে মানুষকে আক্রমণ করে। আমরা এরই মধ্যে হাতির আক্রমণে যাদের মৃত্যু ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছি, যাতে তারা এই প্রাণীকে হত্যা না করে। মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করছি। হাতি সংরক্ষণ প্রকল্প পাস হলে এই প্রাণীটি রক্ষার উদ্যোগ আরও কার্যকর হবে। হাতি রক্ষায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে যেখানে দুর্বলতা রয়েছে তা সংশোধনের জন্য প্রক্রিয়া চলছে। এ নিয়ে বেশ কয়েকটি বৈঠকও হয়েছে।

সর্বশেষ খবর