শনিবার, ১২ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

চট্টগ্রামে এখনো পানিবন্দি সাত ইউনিয়নের মানুষ

মৃত্যু ১৯, নিখোঁজ ৩ দুশ্চিন্তায় পরীক্ষার্থীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে এখনো পানিবন্দি সাত ইউনিয়নের মানুষ

বন্যা শেষ হলেও এখনো পানির নিচে রাঙামাটির বেশির ভাগ এলাকা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার সাত দিনেও স্বাভাবিক হয়নি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা। উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মানুষ এখনো পানিবন্দি জীবন কাটাচ্ছে। সাত দিনে বন্যায় এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৯ জনের ও সাতকানিয়ায় নিখোঁজ রয়েছে তিনজন। সাতকানিয়ার পাশাপাশি বন্যার কবলে পড়েছে লোহাগাড়া ও চন্দনাইশ উপজেলা। এ তিন উপজেলার বেশির ভাগ এলাকা বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এদিকে বন্যায় ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানসহ সব মিলিয়ে ১৩৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ। পাশাপাশি দুশ্চিন্তায় রয়েছে প্লাবিত এলাকার এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, প্রায় উপজেলায় এখন আর পানিবন্দি কেউ নেই, তবে বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি এলাকায় পানি এখনো আছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ উপজেলা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে আমরা পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছি। আজকে দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী আসছেন, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশে ত্রাণ ও পুনর্বাসন উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে।

সাতকানিয়া উপজেলার ইউএনও মিল্টন বিশ্বাস বলেন, উপজেলার মাদার্শ ইউনিয়ন ব্যতীত সব ইউনিয়ন বন্যাকবলিত। এখন ধীরে ধীরে প্রায় এলাকায় পানি নেমে গেছে। তবে এখনো সাতটি ইউনিয়নে পানি রয়ে গেছে। ফলে সেখানকার মানুষ ছোট ছোট ডিঙি নৌকা দিয়ে যাতায়াত করছে। পানিবন্দি থাকা ইউনিয়নের মধ্যে কেওচিয়া, চরতি, আমিলাইশ, নলুয়া, ছদাহা, বাজালিয়া ও সাতকানিয়া সদর ইউনিয়ন। এসব এলাকায় সরকারিভাবে রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয় চেয়ারম্যান ও নানা সংগঠন ত্রাণ দিচ্ছে।

সাতকানিয়া উপজেলার পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় নৌকা উল্টে ভেসে যাওয়া দুই শিশুসহ তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল উপজেলার পৃথক স্থান থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃতরা হলো-দক্ষিণ চরতির সেলিমের ছেলে শহিদুল ইসলাম (৩), কাঞ্চনার আরিফের মেয়ে সানজিদা আক্তার (৪) ও কালিয়াইশের ফজল আহমদের ছেলে মো. ইদ্রিস (৫৫)। সাতকানিয়া থানার ওসি ইয়াসির আরাফাত বলেন, পানির স্রোতে ভেসে যাওয়া তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তা তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। এদিকে বুধবার থেকে পানি কমতে শুরু করায় বিভিন্ন এলাকায় নৌকা ডুবে ও স্রোতের টানে ডুবে নিখোঁজ হওয়া অনেক নারী-পুরুষ ও শিশুর লাশ ভেসে ওঠে। বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত বন্যায় তিন উপজেলা ও মহানগরীতে মোট ১৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তার মধ্যে সাতকানিয়ায় ৭, লোহাগাড়ায় ৪, চন্দনাইশে ২, বাঁশখালীতে ১ ও রাউজানে ১ এবং নগরীতে একজন রয়েছেন। স্থানীয় প্রশাসন মৃত্যুর এই সংখ্যা নিশ্চিত করেছে। শুক্রবার সকালে আনোয়ারা উপজেলার জুইদন্ডীর এলাকায় খোকন নামে একজনের লাশ সাঙ্গু নদীতে ভেসে এসেছে। খোকন বন্যার সময় চন্দনাইশ থেকে নিখোঁজ ছিল।

ত্রাণের জন্য ফোন, পৌঁছে গেলেন জেলা প্রশাসক : নগরীর উত্তর চান্দগাঁও এলাকায় প্রায় জায়গা এখনো পানিতে নিমজ্জিত। কষ্টে সময় পার করছেন কয়েক হাজার বাসিন্দা। খাদ্য সংকটে আছেন এমন কথা জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান জানার পর জলাবদ্ধ ৩০০ পরিবারের হাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক সহায়তা তুলে দিয়েছেন। বিশেষ এই প্যাকেটে ১০ কেজি চাল, ১ কেজি করে ডাল, তেল, লবণ, চিনি, মরিচ, ধনিয়া, হলুদের গুঁড়াসহ আরও কয়েকটি ভোগ্যপণ্য। বিপদের এমন সময়ে উপহারের প্যাকেটটি হাতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন অসহায় মানুষরা।

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনে সমন্বয় করে কাজের আহ্বান : চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনসহ সব উন্নয়ন প্রকল্পের সুফল যেন জনগণ পায় সে জন্য সবাইকে সমন্বয় করে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন চট্টগ্রাম-৭ আসনের এমপি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। গতকাল রাতে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে জেলা প্রশাসন আয়োজিত সমন্বয় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার তোফায়েল ইসলামের সভাপতিত্বে ও জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামানের সঞ্চালনায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, রাঙামাটিতে এখনো পানিবন্দি অর্ধলাখ পরিবার। অব্যাহত আছে বৃষ্টিপাত। পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভেসে যাচ্ছে বসতঘর, ফসলি জমি, দোকানপাট, হাটবাজার ও নলকূপ। খাদ্য সংকটের পাশাপাশি তীব্র সংকট বিশুদ্ধ পানির। অন্যদিকে বানের নোংরা পানিতে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ। ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, ত্রাণের চেয়ে চিকিৎসাব্যবস্থা এখন অতি জরুরি। টানা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় রাঙামাটিতে বাড়ছে কাপ্তাই হ্রদের পানি। অন্যদিকে সীমান্ত থেকে নামছে পাহাড়ি ঢল। তাই দিন দিন প্লাবিত হচ্ছে রাঙামাটির ৫টি উপজেলার নিম্নাঞ্চল। এতে ভোগান্তি বেড়েছে রাঙামাটির বরকল, জুরাছড়ি, লংগদু, বাঘাইছড়ি ও রাজস্থলী উপজেলাবাসীর। এদিকে বান্দরবানে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় বাড়ছে সাঙ্গু নদীর পানি। ভাঙছে পাহাড়। এরই মধ্যে সড়ক ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে থানছি ও বান্দরবানের। বাড়ছে পাহাড়বাসীর ভোগান্তি। প্রশাসনের ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত থাকলেও স্বস্তি ফেরেনি পাহাড়ে। সম্প্রতি টানা বর্ষণে পাহাড়ি ঢল আর সাঙ্গু নদীর পানিতে তলিয়ে যায় বান্দবানের নিম্নাঞ্চল। পানিবন্দি হয়ে পড়ে লাখো মানুষ। শুধু তাই নয়, পাহাড় ধসে বিধ্বস্ত হয়েছে সড়কও। ভারী বর্ষণে এরই মধ্যে বিচ্ছিন্ন আছে বান্দরবান-থানছি সড়ক। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চিম্বুক, জীবননগরসহ সড়কের প্রায় সাতটি স্থান।

খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, খাগড়াছড়ি জেলা সদর ও দীঘিনালা উপজেলার বানভাসি লোকজন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। টানা বর্ষণে পাহাড়ি ঢলে মাঈনী ও চেঙ্গী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে এখানকার প্রায় ৫ শতাধিক পরিবার বন্যার পানিতে ডুবে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানকার নদীর পানি কমে গেলেও দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নে ৫টি আশ্রয় কেন্দ্রে এখনো শতাধিক পরিবার রয়েছে। এসব কেন্দ্রে শিশু, নারী ও বয়ঃবৃদ্ধরা জ¦র, সর্দি, কাশিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এসব কেন্দ্রে সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে। ফেনী প্রতিনিধি জানান, ফুলগাজী ও পরশুরামের বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। নামতে শুরু করেছে লোকালয়ের পানি। টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে মুহুরী ও কহুয়া নদীর তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলা গত সোমবার প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় ১০ গ্রামের অন্তত ১৮০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিজস্ব প্রতিবেদক, বগুড়া জানান, বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। তবে পানি এখনো বিপৎসীমার নিচেই রয়েছে। এদিকে পানি বৃদ্ধিতে নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে। আতঙ্কিত রয়েছে এলাকাবাসী। ভাঙনকবলিত এলাকায় জিওব্যাগ ফেলা হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি গত কয়েক মাস ধরেই ওঠানামা করছে। এ মাসের ১ আগস্ট যমুনার পানির উচ্চতা ছিল ১৫.১০ মিটার। গতকাল সকালে সারিয়াকান্দিতে পানির উচ্চতা ছিল ১৫.৪৭ মিটার। সারিয়াকান্দিতে যমুনার পানির বিপৎসীমা ১৬.২৫ মিটার। তাই পানি এখনো বিপৎসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বগুড়া জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক জানান, উজানে ভারী বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলের কারণে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর