সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

শুধু নামেই বাজার মনিটরিং

ভোক্তা অধিকার ছাড়া বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে মনিটরিং টিমগুলো কার্যত অচল। চিঠি চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ কার্যক্রম, সিন্ডিকেটের দোহাই দিয়ে সবখানে বাড়ছে দাম

মানিক মুনতাসির

ঢাকাসহ সারা দেশের নিত্যপণ্যের বাজারে চলছে অরাজক পরিস্থিতি। উৎপাদন ও সরবরাহে ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও দাম বাড়ছে দফায় দফায়। চাল, ডাল, তেল, পিঁয়াজ, রসুন, আটা, চিনি, ডিম, মাছ, মাংসসহ এমন কোনো পণ্য নেই যেটার দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়ছে না। পাইকারি বাজার, আড়তসহ খুচরা পর্যায়ে কোথাও নেই তেমন কোনো মনিটরিং। সম্প্রতি ডিমের বাজার নিয়ে হইচই পড়ে গেলেও এ নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে দাম কমছে না কিছুতেই। শুধু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর ছাড়া অন্য কোনো সংস্থার বাজার মনিটরিং চোখে পড়ে না। অবশ্য ইস্যু কিংবা অকশনভিত্তিক ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে থাকে বিএসটিআই। যার কোনো ইতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়ে না বললেই চলে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাজার মনিটরিংয়ে যে সংখ্যক জনবল দরকার তা আমাদের নেই। এ ছাড়া অসৎ ব্যবসায়ীদের এই সিন্ডিকেট ভেঙে কাজ করাও দুরূহ বলে তিনি মনে করেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মনিটরিং না থাকা, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারা এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে জবাবদিহিতা না থাকায় বাজারে সরকার প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। অসৎ ব্যবসায়ীরাই অনেকাংশে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করেন বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, বাজারে জবাবদিহিতা আনতে হলে সবার আগে মনিটরিং বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। বর্তমান বাজারব্যবস্থা পুরোটাই সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এই সিন্ডিকেটের খবর সরকারও জানে বলে তিনি মনে করেন।

প্রতি বছর রমজান মাসে বাজার মনিটরিং নিয়ে তোড়জোড় চালায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাজার মনিটরিংয়ের জন্য পৃথক একটি শাখাও রয়েছে। শুধু দৈনন্দিন দাফতরিক দায়িত্ব পালন ছাড়া আর কোনো কাজে তাদের দেখা যায় না। অবশ্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এই শাখা বাজারের দর পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে থাকে। তবে এর কোনোটাই বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে না। নিত্যপণ্যের আমদানি-মজুদ ও সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়েও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আলাদা একটি শাখা রয়েছে। সে শাখাটিও রুটিনমাফিক কাজের বাইরে তেমন কিছু করে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা মাঝে মাঝে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। তাঁরা গণমাধ্যমে বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন। অথচ তা কার্যত ইতিবাচক ফল বয়ে আনে না। বাণিজ্যমন্ত্রী গতকালও ডিম আমদানির ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, দাম না কমলে শিগগিরই আমদানি করা হবে। এর আগে ঈদুল আজহার সময় পিঁয়াজের বাজারে কোনো কারণ ছাড়াই অস্থিরতা সৃষ্টি হলে বাণিজ্যমন্ত্রী পিঁয়াজ আমদানির ঘোষণা দেন। আমদানিও করা হয়। অবশ্য পিঁয়াজ এখনো ৫০ টাকা কেজিতেই বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। এদিকে বিভাগীয় পর্যায়ের বাজার মনিটরিংয়ের জন্য পৃথক পৃথক টিম রয়েছে, সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলোরও আইনি অধিকার রয়েছে বাজার মনিটরিংয়ের। অথচ এসব টিম সারা বছর কোনো কাজ করে না। শুধু রোজার সময় দু-একদিন বাজারে গিয়ে তারা তাদের দায়িত্ব শেষ করেন। আবার তারা যৎসামান্য মনিটরিং করে মাঠ পর্যায় থেকে প্রতিবেদন দিলে সেটা মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পৌঁছতে অনেক সময় পেরিয়ে যায়। সেটা আদৌ কোনো কাজে আসে না বলে জানিয়েছেন খোদ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা। ফলে বাজার মনিটরিংয়ের বিষয়টি অনেকটা চিঠি চালাচালি আর হুমকি-হুঁশিয়ারিতেই আটকে থাকে। মাঠ পর্যায়ে বাজার মনিটরিং জোরদার করার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠিও দেওয়া হয়। কিন্তু সেগুলো কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখে না বাজার নিয়ন্ত্রণে। ডিম, মাছ, মাংস, চাল, চিনি এ রকম ভিন্ন পণ্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দফতরগুলোকে চিঠি লিখেই দায় শেষ করে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়। ডিমের দাম ইতিহাসের রেকর্ড পরিমাণ বাড়লেও একই রকম চিত্র দেখা গেছে বাণিজ্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে। ফলে বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙা তো দূরের কথা বাজার মনিটরিংও জোরদার করা সম্ভব হয় না।

সর্বশেষ খবর