সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

জঙ্গি ফরহাদের তথ্যেই অপারেশন হিল সাইড

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ এলাকা থেকে গ্রেফতার মো. ফরহাদ হোসেনের তথ্যেই বেরিয়ে আসে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার জঙ্গি আস্তানার খবর। ওই দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় লোকচক্ষুর অন্তরালে কথিত ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে তার কিছু অনুসারী আস্তানা স্থাপন করেছেন। কথিত ইমাম মাহমুদের আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয়ে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের টাট্টিউলি গ্রামে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তৈরি করতে ৫০ শতাংশ জমি কেনা হয়েছিল। সেখানেই স্থাপন করা হয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। শনিবার গোয়েন্দা তথ্যে টাট্টিউলি গ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় পরিচালনা করা হয় ‘অপারেশন হিল সাইড’। গতকাল অভিযানসহ সার্বিক বিষয়ে সাংবাদিকদের অবহিত করেন ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান।

সিটিটিসি প্রধান বলেন, সম্প্রতি যশোর, সিরাজগঞ্জ, জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন বয়সী লোকদের পরিবারসহ এবং পরিবার ছাড়া নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে তথ্য পেয়ে অনুসন্ধান শুরু করে সিটিটিসির কাউন্টার টেররিজম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন। এদের মধ্যে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থেকে ডা. সোহেল তানজীম রানা, যশোর থেকে ঢাকার নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী ফাহিম, জামালপুর থেকে এরশাদুজ্জামান শাহিনসহ আরও অনেকের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। এরই সূত্র ধরে অনুসন্ধানের একপর্যায়ে ৭ আগস্ট রাজধানীর গাবতলী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ঝিনাইদহ, মেহেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কথিত ইমাম মাহমুদের আহ্বানে হিজরতের মাধ্যমে সপরিবার গৃহত্যাগ করে আসা ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের সঙ্গে থাকা আট শিশুকে নেওয়া হয় হেফাজতে। গ্রেফতার ব্যক্তিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে আসাদুজ্জামান বলেন, তারা বিশ্বাস করেন ‘ইমাম মাহাদী’র অগ্রবর্তী হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছেন কথিত ইমাম মাহমুদ। বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে ইমাম মাহাদীর পূর্ব যে ‘দুর্বল প্রকৃতির’ ব্যক্তির আবির্ভাবের কথা বলা হয়েছে, তাদের নেতা ‘ইমাম মাহমুদ’ সেই ব্যক্তি। আর এই কথিত ইমাম মাহমুদ ভারতীয় উপমহাদেশে জিহাদে নেতৃত্ব দেবেন। গ্রেফতার ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, কথিত ইমাম মাহমুদ তাদের বলেছেন, যারা এই জিহাদে অংশগ্রহণ করবেন তারা সবাই পরকালে পুরস্কারপ্রাপ্ত হবেন। জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের প্রথম ধাপ হলো গৃহত্যাগ তথা হিজরত। তাই জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের উদ্দেশ্যে ইমাম মাহমুদের নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়ার জন্য তারা সবাই ঘটনাস্থলে মিলিত হয়েছিলেন।

সিটিটিসি প্রধান বলেন, কথিত ইমাম মাহমুদের জামিল নামের এক অনুসারী কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের টাট্টিউলি গ্রামে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপনের জন্য ৫০ শতাংশ জমি কিনেছিলেন। সেখানেই প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল। ওই জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে চারজন পুরুষ এবং ছয়জন নারীসহ ১০ জনকে আটক করা হয়। অভিযানে জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক, ৫০টি ডেটোনেটর, রামদাসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র, কমান্ডো রুট, পাঞ্চিং ব্যাগ ও অন্যান্য প্রশিক্ষণ সামগ্রী, উগ্রবাদী বই, নগদ অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হলে আটক ব্যক্তিদের ওই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।

সিটিটিসি প্রধান বলেন, অভিযুক্তদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, কথিত ইমাম মাহমুদের আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা ছয়টি পরিবার হিজরতের জন্য গৃহত্যাগ করেছে। তাদের মধ্যে মেহেরপুর জেলা থেকে হিজরত করা পাঁচটি পরিবার এবং ঝিনাইদহ থেকে হিজরত করা একটি পরিবার আছে। সেখানে গ্রেফতার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হলে অধিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জঙ্গিরা সক্রিয় হচ্ছে কি না, তাদের কোনো নাশকতার পরিকল্পনা রয়েছে কি না- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সিটিটিসি প্রধান বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তাদের কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে কি না তা জানতে আমরা কাজ করছি।’ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ইমাম মাহমুদ বলে যে ব্যক্তি নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন তিনিসহ এ সংগঠনের অন্য সদস্যরা আমাদের নজরদারিতে রয়েছেন। আমরা তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছি। তাদের গ্রেফতার করা গেলেই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া যাবে।’ আস্তানাটি কত দিন আগে স্থাপন করা হয়েছিল জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, ‘দুই মাস আগে আস্তানাটি স্থাপন করা হয়েছিল। আস্তানা তৈরি করার জন্য ৫০ শতক জায়গা কেনা হয়েছিল। যার নামে ওই জমির দলিল করা হয়েছিল সেই দলিলগ্রহীতার নামও আমরা পেয়েছি। তবে কত টাকা দিয়ে জমি কেনা হয়েছিল সে বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। সদস্যদের জিহাদের জন্য যা যা করা প্রয়োজন ছিল সবকিছুই ওখান থেকে পরিচালনা করা হতো।’

আসামিরা রিমান্ডে : মৌলভীবাজারের কুলাউড়া থানার দুর্গম পাহাড়ি এলাকার জঙ্গি আস্তানা থেকে গ্রেফতার ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’র ৯ আসামির প্রত্যেকের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মোশাররফ হোসেনের আদালত। একই মামলায় গ্রেফতার অপর দুই আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিটিটিসির উপপরিদর্শক শাহজাদা মোহাম্মদ আবদুল্লা আল মামুন ৯ আসামিকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। রিমান্ডে নেওয়া আসামিরা হচ্ছেন মো. হাফিজুল্লাহ, রাফিউল, শরীফুল ইসলাম, খাইরুল ইসলাম, সানজিদা খাতুন, মাইশা ইসলাম, আমেনা, হাবিবা বিনতে শরীফুল ও ফরহাদ হোসেন ওরফে শিপন। এদের মধ্যে আসামি ফরহাদকে ঢাকার মিরপুর থেকে এবং অন্যদের মৌলভীবাজার থেকে গ্রেফতার করা হয়। কারাগারে পাঠানো আসামিরা হচ্ছেন শাপলা ও মেঘলা আক্তার। তাদের মধ্যে আসামি শাপলাকে দুগ্ধপোষ্য দেড় বছর বয়সী মেয়ে ও পাঁচ বছর বয়সী ছেলে এবং আসামি মেঘলাকে দুগ্ধপোষ্য এক বছর বয়সী মেয়েসহ হাজতে পাঠানো হয়।

সর্বশেষ খবর