বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

নকল প্রসাধনীতে বাজার সয়লাব

আসল-নকল চেনা দায়, নেই তদারকি, নামি কোম্পানির পণ্যের মোড়কে নেই নিরাপত্তা সিল

শামীম আহমেদ

নকল প্রসাধনীতে বাজার সয়লাব

বিভিন্ন নামকরা সুপারশপ থেকে শুরু করে গলির মোড়ের মনোহরি দোকানে থরে থরে সাজানো অসংখ্য ব্র্যান্ডের প্রসাধনী। চোখ ধাঁধানো মোড়কে বিক্রি হচ্ছে হেয়ার অয়েল, লোশন, শ্যাম্পু, শাওয়ার জেল, পারফিউম, স্কিন ক্রিমসহ আরও অনেক পণ্য। দেশি পণ্যের পাশাপাশি রয়েছে আমদানি করা বিদেশি পণ্য। চড়া মূল্যে এসব প্রসাধনী বিক্রি হলেও নেই আসল-নকল যাচাইয়ের সুযোগ। হাতে গোনা কিছু পণ্য বাদে অধিকাংশেরই মোড়কে নেই নিরাপত্তা সিল। ফলে থাকছে না পণ্য যাচাইয়ের সুযোগ। চড়া দামে নকল পণ্য কিনে ঘরে ফিরছেন ক্রেতা। এতে ক্রেতা শুধু আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তই হচ্ছেন না, পড়ছেন নানা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।

রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শুধু বড়দের প্রসাধনী পণ্যই নয়, শিশুদের বেবিশ্যাম্পু, বেবি শাওয়ার জেল, বেবিঅয়েল, বেবিলোশনের বোতলেও নেই কোনো নিরাপত্তা সিল। অনায়াসেই সেসব বোতল থেকে প্রসাধনী বের করা যায়, আবার ঢুকানো যায়। সম্প্রতি খিলক্ষেতের ডুমনি এলাকায় একটি দোকানে বাচ্চার জন্য শ্যাম্পু কিনতে গিয়ে বিক্রেতার সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন সাখাওয়াত হোসেন। দেশের বড় একটি কোম্পানির বেবি শ্যাম্পুর বোতলের মুখ খোলা থাকায় (প্লাস্টিকের নিরাপত্তা সিল বা কিউসি স্টিকার নেই) তিনি নকল পণ্য বিক্রির অভিযোগ করেন। বিব্রত বিক্রেতা বাধ্য হয়ে ওই কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধির নম্বর দেন। তাকে ফোন দিলে তিনি বলেন, আগে কিউসি স্টিকার ছিল, এখন প্লাস্টিক দিয়ে সিল করা হয়েছে। তাকে প্লাস্টিকের লক নেই বলে জানালে তিনি অফিসে আলাপ করে পরে জানাবেন বললেও আর যোগাযোগ করেননি। ওই দোকানে দুয়েকটি পণ্য ছাড়া অধিকাংশ শ্যাম্পু, হেয়ার অয়েল, শাওয়ার জেল, পারফিউম সিল ছাড়া অবস্থায় পাওয়া যায়। বিষয়টি পরীক্ষা করতে পার্শ্ববর্তী আলমগীর স্টোরে গেলে দোকানের মালিক তিন-চার ধরনের হেয়ার অয়েল ও শ্যাম্পুর বোতল দেখিয়ে বলেন, একটি হেয়ার অয়েল ছাড়া অন্য কোনো বোতলে সিল নেই। চাইলে সব বোতল থেকে একটু একটু তেল বা শ্যাম্পু ব্যবহার করে আবার বিক্রি করা যায়। কোনো বিক্রয় প্রতিনিধি নকল পণ্য দিয়ে গেলেও বোঝার উপায় নেই। বিষয়টি যাচাই করতে ভাটারা এলাকার দুটি সুপার শপে গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র। শুধু দেশি পণ্য নয়, বিদেশ থেকে আমদানি করা প্রসাধনীর বোতলও সিলছাড়া দেখা গেছে। ক্রেতা সাখাওয়াত হোসেন অভিযোগ করেন, শিশুর জন্য কিছু নিতে গেলে আমরা সর্বোচ্চ সচেতন থাকি। আর আমি সব সময় দেশে উৎপাদিত পণ্য কেনার চেষ্টা করি। অথচ, শুধু জনসন ও জাস্ট ফর বেবি ব্র্যান্ডের বেবি শ্যাম্পুর মুখ সিল করা দেখলাম না। কডোমো টপ টু টো শাওয়ার জেল থাইল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত বলা হলেও বোতলের মুখে কোনো সিল নেই। এগুলো খিলক্ষেতের কোনো ঘরের ভিতরে তৈরি হয় কিনা তা কীভাবে বুঝব? এ ছাড়া হেয়ার অয়েলের মুখ সিলছাড়া হয় কীভাবে? পরিবহনের সময় তো তেল পড়ে যেতে পারে! সহজে নকল হতে পারে। এদিকে গত তিন বছরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে কোটি কোটি টাকার নকল প্রসাধনী জব্দ করেছে র‌্যাব ও বিএসটিআই। ২০২১ সালে শুধু কেরানীগঞ্জের একটি কারখানা থেকেই ২ কোটি টাকা মূল্যের নকল প্রসাধনী উদ্ধার করা হয়। গত ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকায় ও গত ১৩ আগস্ট চট্টগ্রামের কোতোয়ালি এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নকল প্রসাধনী উদ্ধার করা হয়। এসব নকল প্রসাধনীর মধ্যে ছিল ইউনিলিভার, জনসন অ্যান্ড জনসনসহ বিভিন্ন নামকরা কোম্পানির পণ্য। ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে কালার কসমেটিকস ও স্কিন কেয়ার পণ্যের চাহিদাই ছিল প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার। এর ৯৭ ভাগের জোগানই আনুষ্ঠানিক উৎসহীন। অর্থাৎ, নকল পণ্য তৈরি এবং শুল্ক ফাঁকি দেওয়া আমদানির মাধ্যমে পূরণ হয় এই চাহিদা। এতে শুধু ক্রেতাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব। চিকিৎসকরা বলছেন, সাবান, শ্যাম্পু, লোশন, স্কিন ক্রিম সবই নাক-মুখের কাছাকাছি ব্যবহৃত হয়। নকল প্রসাধনীতে বিপজ্জনক মাত্রায় মার্কারি, হাইড্রোকুইনোন, লেডসহ নানা ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকতে পারে। এগুলো শুধু ত্বক নয়, নানাভাবে শরীরে প্রবেশ করে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে। সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে শিশুরা। শিশুদের ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট বাধাগ্রস্ত হয়। মা ব্যবহার করলে গর্ভের শিশুর ক্ষতি হয়। দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। কিডনি, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এদিকে বাজারে ক্ষতিকর প্রসাধনীর ওপর নজরদারি করে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। গত ১ জুন ক্ষতিকর ১৮টি রং ফর্সাকারী স্কিন ক্রিম ও একটি স্কিন লোশন বিক্রি ও বিতরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকারি সংস্থাটি। তবে বিখ্যাত ব্র্যান্ডের আড়ালে নকল পণ্য বিক্রি নজরদারির বাইরেই থেকে যাচ্ছে। বোতলের মুখ সিল করার নিয়মের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএসটিআইর উপপরিচালক (সিএম) মো. রিয়াজুল হক বলেন, নকল ঠেকানোর জন্য এই কাজটা তো কোম্পানিগুলোরই করা উচিত। কারণ, নকল হলে তাদেরই ক্ষতি। বিষয়টি এর আগে কখনো আলোচনায় আসেনি। এটা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর