শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা
কষ্টের জীবন - ১

ভাত-ভর্তায় দিন পার নিম্নবিত্তের

♦ মাসে একবার জোটে ছোট রুই, পাঙাশ ♦ সন্তানের আবদারে একবার ফার্মের মুরগি ♦ কমে এসেছে ডিম খাওয়া

জিন্নাতুন নূর

ভাত-ভর্তায় দিন পার নিম্নবিত্তের

শুধু ভাত-ভর্তা খেয়েই দিন পার করছে রাজধানীর নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ। এর সঙ্গে দামে কম হলে কিছু শাকসবজি তাদের খাবার পাতে বাড়তি যোগ হচ্ছে। তবে যারা সবজি খাচ্ছে তারা তাজা সবজি কিনতে পারছে না। সবজির মধ্যে বেশির ভাগই আলুর ওপর নির্ভরশীল। আগে এই শ্রেণির মানুষ ডিম দিয়ে আমিষের চাহিদা পূরণ করলেও দাম বেড়ে যাওয়ার পর এখন খাবারের তালিকা থেকে ডিমও বাদ যাচ্ছে। মাসে দু-এক বার চাষের পাঙাশ, ছোট রুই ও তেলাপিয়া মাছ খাচ্ছে। ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো এই প্রাণিজ আমিষ থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে। সন্তানের আবদার পূরণে বা বাড়িতে মেহমান এলে হয়তো মাসে একবার তারা ব্রয়লার মুরগি খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আর কোরবানি ঈদ ছাড়া নিম্নবিত্ত এখন আর গরুর মাংস খাওয়ার কথা ভাবতেও পারছে না। সম্প্রতি ঢাকার নিম্নবিত্ত শ্রেণির বেশ কয়েকজন পেশাজীবীর সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া যায়।

বাংলামোটরের একটি বেসরকারি ব্যাংকের বুথে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করেন হানিফ মিয়া। তার বেতন ৮ হাজার টাকা। সংসার চালাতে হানিফের স্ত্রী রহিমাও গার্মেন্টে কাজ করছেন। তার বেতন ১২ হাজার। এ দম্পতির তিন সন্তানই শিক্ষার্থী। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে পাঁচজনের সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন হানিফ-রহিমা। হানিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পুরা মাসই ভাত-ভর্তা ও কম দামি সবজি খেয়ে দিন পার করছি। দাম কম দেইখা মাসে একবার ছোট রুই ও চাষের পাঙাশ খাই। পোলাপাইন আবদার করলে একবার ব্রয়লার মুরগি কিনি। ডিমের দাম বাড়ায় এখন ডিম খাওয়াও ছাইড়া দিছি।’

মিরপুর পল্লবী দুয়ারিপাড়া বস্তিতে থাকেন গৃহকর্মী নাজমা বেগম। চারটি বাসায় কাজ শেষে মাসে মোট ৯ হাজার টাকা পান। নাজমার স্বামী একটি অ্যাপার্টমেন্টে কেয়ারটেকারের কাজ করেন। মাসে পান ১০ হাজার টাকা। চার সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে এ দম্পতিকেও এখন যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। নাজমা বলেন, ‘আগে ৫০০ টাকায় এক সপ্তাহের বাজার করতে পারতাম এখন দুই দিনও চলে না।’ তিনি জানান, তিন মাস পর গতকাল তার স্বামী বাজার থেকে একটি তেলাপিয়া ও চাষের ছোট আকারের পাঙ্গাশ মাছ কিনেছেন। নিজেরা না খেয়ে এ দম্পতি সন্তানদের মাছ খেতে দেন। বেশির ভাগ দিনই তারা আলু ভর্তা ও পাতলা ডাল দিয়ে ভাত খান। কোরবানি ঈদ ছাড়া গরুর মাংস খেতে পারছেন না গত তিন-চার বছর। বাসায় মেহমান এলে মাসে একবার ব্রয়লার মুরগি খান। আর আগে মাঝেমধ্যে ডিমের তরকারি খেলেও এখন দাম বেড়ে যাওয়ায় তা-ও খাওয়া হচ্ছে না।

ভাড়া চুক্তিতে মোটরসাইকেল চালান রফিক হাসান। মা-বাবা, দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন রাজধানীর কালশী। মাস শেষে তার আয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার বাজার করেন। তিনি জানান, চাল ও তেল কেনার পর যে টাকা থাকে তাতে কম দামি শাকসবজি ছাড়া আর কিছু কেনা যায় না। এজন্য ভর্তা, শাকসবজি খেয়েই বেশির ভাগ দিন কাটে। সামাজিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উবিনীগ (উন্নয়ন বিকল্প নীতিনির্ধারণী গবেষণা) সম্প্রতি একটি জরিপ করে। এর জন্য ২০০ গরিব পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা হয়। সেখানে ছিলেন চায়ের দোকানদার, চটপটি বিক্রেতা, দর্জি, গার্মেন্ট শ্রমিক, রিকশা ও ভ্যান চালক ইত্যাদি। এদের আয় খুব কম। দৈনিক হিসেবে বেশির ভাগ (প্রায় ৬০%) মানুষের আয় গড়ে মাত্র ২৭৬ টাকা। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের গড় আয় ৫০০ টাকা। কিছু লোকের আয় ৫০০ টাকার বেশি। বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্য নিরূপণের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হচ্ছে ১ দশমিক ৯০ ডলার বা ২০০ টাকার কিছু বেশি। এর অর্থ, এই মানুষগুলো বিশ্বব্যাংকের দরিদ্র মানুষের সংজ্ঞার কাছাকাছি। আয় কম থাকা এই মানুষগুলোর মধ্যে ভাত, ডাল ও ডিম খাচ্ছে মাত্র ২৭%। ভাত ও সবজি খাচ্ছে ২২% পরিবার। পোলট্রি ডিমের দাম কম হওয়ায় এতদিন অনেক গরিব পরিবার তা খেয়েছে। কিন্তু ডিমের বাড়তি দামের কারণে এখন অনেক পরিবার ডিম খাওয়াও ছেড়ে দিচ্ছে। মৌসুমি সবজির দাম কমে গেলেই এই নিম্নবিত্তরা খেতে পারেন। দেখা যায়, মাছ খাওয়ার ভাগ্য জুটেছে মাত্র ১২% পরিবারের। তা-ও মাঝে মাঝে। মাংস খাওয়ার কথা বলে ২০০ পরিবারের মধ্যে মাত্র তিনটি। দুধের অবস্থাও একই। মাসের সব দিন খাবার জোটেনি এমন পরিবারের সংখ্যা ৫৭ বা ২৮%। এদের কেউ পাঁচ দিন আবার কেউ ১০ দিন পর্যন্ত অভুক্তও থেকেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিম্নমধ্যবিত্তের পাত থেকে বহু আগেই পুষ্টিকর খাবার উঠে গেছে। ডিম, ডাল ও ব্রয়লার মুরগি এবং গরিবের মাছ বলে পরিচিত পাঙ্গাশ দিয়ে এতদিন গরিবরা আমিষের চাহিদা মেটাত। কিন্তু এখন এ খাবারগুলোর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সপ্তাহে এক দিন মাছ কিনত যারা, তারাও এখন বিপাকে পড়েছে। আগে যারা টাকা জমিয়ে মাসে এক-দুবার মাংস কিনে খেত তাদের কাছেও এখন মাংসের বাজার দুঃস্বপ্নের মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. সাইদুল আরেফিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পুষ্টিকর খাবার ও আমিষের অভাবে মানুষের দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের শারীরিকভাবে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর বড়দের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে ওজন হ্রাসের ঘটনা ঘটতে পারে। এর ফলে মানুষের কর্মক্ষমতা কমে যাবে এবং একই সঙ্গে শারীরিক দুর্বলতার জন্য কাজ করার ইচ্ছাও কমে আসবে।

সর্বশেষ খবর