শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

নীতিমালায় আটকে যাচ্ছে রপ্তানি খাত

সমীক্ষায় মতামত ৬৫ শতাংশের

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

০১ : তৈরি পোশাকের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি খাত ছিল চামড়া। সাভারে শিল্পনগরীতে সিইটিপি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় এই খাতের রপ্তানি এখন হুমকির মুখে। এক দশক আগেও যেখানে কাঁচাচামড়ার দাম ছিল ২ থেকে ৩ হাজার টাকা, এখন তা দু-তিন শ টাকাতেও বিক্রি হয় না।

০২ : রপ্তানি খাতের সম্ভাবনাময় পণ্যের মধ্যে ছিল বাংলাদেশের গলদা চিংড়ি। নানা অপদ্রব্য মিশিয়ে সুনাম নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ঘেরগুলোর পরিবেশে নজর না দেওয়ায় ভাইরাসের আক্রমণে বিদেশের বাজারে এখন বাংলাদেশের চিংড়ি, হিমায়িত মাছের চাহিদা নাই বললেই চলে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভেনামি চিংড়ি চাষ করে রপ্তানির বাজার ধরলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর এই চিংড়ির পোনা আমদানির অনুমতি দিচ্ছে না।

০৩ : বাংলাদেশের শাকসবজি ও ফলসহ কৃষিপণ্য রপ্তানির একটি বড় বাজার হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। অথচ এসব পণ্যে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান শনাক্ত হওয়ায় নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের খাদ্য ও কৃষিপণ্য রপ্তানি। ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান থাকায় সুইডেন বাংলাদেশের সুগন্ধি চাল ও মুড়ির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

০৪ : বর্তমান বিশ্বে প্রায় ১৮০ কোটি মুসলিম ভোক্তার পণ্য ও সেবার চাহিদার ভিত্তিতে গড়ে ওঠেছে আনুমানিক আড়াই লাখ কোটি ডলারের বৈশ্বিক হালাল পণ্য, কাঁচামাল ও সেবার বাজার। মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে এই হালাল পণ্যের বাজার ধরার সুযোগ ছিল বাংলাদেশের। অথচ হালাল পণ্যের সদন দেওয়ার জন্য কোনো পৃথক স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ না থাকায় সম্ভাবনাময় এই বাজার ধরা যাচ্ছে না।

ওপরের এই চারটি ইস্যু ছাড়াও দেশের প্রতিটি রপ্তানি পণ্য কোনো না কোনো নীতিমালায় আটকে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তৈরি পোশাকের বাইরে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তাগিদ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণে পরামর্শ দিচ্ছে। অথচ গত এক দশকে এ বিষয়ে অগ্রগতি কাগজে কলমে নির্দেশনার মধ্যেই রয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, দেশে চামড়া শিল্পের সিইটিপির বিষয়টি শিল্প মন্ত্রণালয়ের হাতে; কৃষিপণ্যের বিষয়টি দেখভাল করে কৃষি মন্ত্রণালয়; চিংড়ি ও হিমায়িত মাছের বিষয়টি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় দেখছে; হালাল পণ্যে সার্টিফিকেট দিচ্ছে বিএসটিআই। সামগ্রিকভাবে রপ্তানির বিষয়টি দেখছে আবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পৃথক পণ্যের বিষয়ে পৃথক সংস্থার সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার থাকায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা যাচ্ছে না। সরকারের একটি জরিপেও এ বিষয়টি উঠে এসেছে। সম্প্রতি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) দেশের ১৪টি রপ্তানি-সহায়ক সংস্থার ওপর একটি জরিপ চালায়। ওই জরিপের তথ্য অনুযায়ী ৬০ শতাংশ জানিয়েছেন, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও আমদানিকারকরা পণ্যের ন্যয্য মূল্য না দেওয়ার কারণে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জরিপে অংশ নেওয়া অর্ধেকের মতে অশুল্ক বাধা রপ্তানিতে বাধা সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষতার অভাব, ব্যাংকঋণের মতো বিষয়গুলোও রপ্তানির সমস্যা হিসেবে জরিপে উঠে এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ রপ্তানিকারক জানিয়েছেন, ‘সরকারি কিছু নীতিমালা রপ্তানি বৃদ্ধিতে সহায়ক নয়’।

নিট তৈরি পোশাক রপ্তানিকারদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারের সংস্থাগুলো যখন কোনো নীতিমালা করে, তখন সেখানে কিছু অস্পষ্টতা থাকে। বাস্তবায়ন পর্যায়ে এই অস্পষ্টতা নিয়ে বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি হয়। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে আন্তরিকতা থাকলেও নিচের দিকের কর্মকর্তারা এসব অস্পষ্টতাকে পুঁজি করে নানা ধরনের বাধা সৃষ্টি করেন। তৈরি পোশাক খাতের এই নেতা আরও জানান, তাঁদের ক্ষেত্রে তাঁরা প্রায়শই রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে কাস্টমসের বাধার মুখে পড়েন। তিনি বলেন, ইজি অব ডুয়িং বিজনেসে ব্যবসা সহজীকরণের কথা বলা হলেও এটি আসলে দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। জরিপে রপ্তানিকারকরা সেই বিষয়গুলোই তুলে ধরেছেন বলে মনে করেন এই রপ্তানিকারক।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)-এর ভাইস চেয়ারম্যান ও সিইও এ এইচ এম আহসান অবশ্য এই জরিপের বিষয়টি দিয়ে রপ্তানি খাতকে বিবেচনা না করার পরামর্শ দেন। তার মতে, ইউক্রেন যুদ্ধের পরও দেশের রপ্তানি খাতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি বজায় রয়েছে, যা দেশের সক্ষমতার বিষয়টি প্রমাণ করে। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তিনি বলেন, সাভারে সিইটিপি স্থাপন হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে চামড়া রপ্তানিতে সমস্যা থাকবে না। একইভাবে উত্তম কৃষি চর্চার জন্য নীতিমালাও করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। ভেনামি চিংড়ি চাষেও কিছু প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। রপ্তানি বাড়াতে সরকারের এসব কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া, যার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে সুফল মিলবে।

সর্বশেষ খবর