রবিবার, ২০ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা
অষ্টম কলাম

বাংলাদেশি-রোহিঙ্গা চক্র, মিয়ানমারে আটকে টাকা আদায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার সময় নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের যুবকদের মিয়ানমারে আটকে রেখে নির্যাতনে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের তিনজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। সংস্থাটি জানিয়েছে, ওই তিনজনের মধ্যে পাচার চক্রের বাংলাদেশের হোতা ইসমাইল রয়েছেন। গ্রেফতার তার দুই সহযোগী হলেন জসিম ও এলাহী। র‌্যাব-১১-এর একটি দল শুক্রবার রাতে নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এ নিয়ে গতকাল দুপুরে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ১৯ মার্চ নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার ২২ যুবক মানব পাচার চক্রের মাধ্যমে টেকনাফ থেকে নৌপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় মিয়ানমারের কোস্টগার্ডের কাছে আটক হন। পরে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা ১০ জুলাই আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে গিয়ে তাদের স্বজনদের ফিরে পেতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার আবেদন জানান। আবুল কালাম আজাদ নামের একজন আড়াইহাজার থানায় মানব পাচার আইনে একটি মামলাও করেন। এই চক্রের মাধ্যমে মালয়েশিয়া যাওয়া জহিরুল ইসলাম ২৪ মে দেশটির একটি হাসপাতালে মারা যান। ২৮ মে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তার লাশ দেশে আনা হয়। এদের দুজন মালয়েশিয়ায় আছেন। ১৯ জন আছেন মিয়ানমারে। কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার ইসমাইল ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় অবস্থানকালে মিয়ানমারের রাখাইনের রোহিঙ্গা রশিদুল ও জামালের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। পরবর্তী সময়ে ইসমাইল দেশে ফিরে রশিদুল ও জামালের সঙ্গে যোগসাজশে ১০ থেকে ১২ জনের একটি আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্র গড়ে তোলেন। স্থানীয় এজেন্টদের যোগসাজশে বাংলাদেশে মানব পাচার চক্রটির শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার তরুণদের কোনো ধরনের অর্থ ও পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পৌঁছানো হবে এবং মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে প্রলোভন দেখাতেন। এ টাকার ভাগের ৩০ হাজার করে পেতেন ইসমাইল, জসিম ও আলম। চক্রের অন্য সদস্যরা ১০ হাজার করে পেতেন। বাকি ২ লাখ ২০ হাজার টাকা মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রশিদুলের কাছে মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো হতো।

যেভাবে যাত্রা : কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রথমে নারায়ণগঞ্জ থেকে বাসে করে কক্সবাজারের টেকনাফের মানব পাচার চক্রের আরেক সদস্য বাংলাদেশি আলমের কাছে যুবকদের হস্তান্তর করা হয়। টেকনাফের আলম ভুক্তভোগীদের কয়েক দিন রেখে সুবিধাজনক সময়ে ট্রলারে করে মিয়ানমারে জামালের কাছে পাঠিয়ে দেন। জামাল তার ক্যাম্পে বাংলাদেশি যুবকদের রেখে নির্যাতন করেন এবং তা ভিডিও করে ইসমাইলের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। যাদের পরিবার মুক্তিপণের টাকা দিত, তাদের মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে মালয়েশিয়ায় রশিদুলের কাছে পাঠানো হতো। রশিদুল ২৫ বছর মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। তিনি ২০ বছর ধরে মানব পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত।

২২ জনের যে পরিণতি : র‌্যাব বলছে, মানব পাচার চক্রটি ১৯ মার্চ ২২ জনকে ট্রলারে করে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাচার করছিল। ওই সময় মিয়ানমার উপকূলে দেশটির কোস্টগার্ড ১৯ জনকে গ্রেফতার করে। বাকি তিনজনকে চক্রের সদস্য জামাল কৌশলে ছাড়িয়ে তার ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন করেন। এর মধ্যে জহিরুলের পরিবারের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। জহিরুলের পরিবার ১০ মে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা পাঠায় এবং অবশিষ্ট ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর পাঠাবে বলে জানায়। জহিরুলকে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমা হয়ে সিঙ্গাপুরের পাশ দিয়ে মালয়েশিয়া পাঠানো হয়। নির্যাতনের কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে মালয়েশিয়া পুলিশের মাধ্যমে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তী সময়ে ২৪ মে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।

মৃত্যুসনদে প্রাণহানির কারণ হিসেবে শরীরে নির্যাতনের কথা উল্লেখ আছে। র‌্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, ২৮ মে জহিরুলের লাশ বাংলাদেশে এনে তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মিয়ানমার কোস্টগার্ডের হাতে আটক বাকি ১৯ জনকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে।

সর্বশেষ খবর