শিরোনাম
সোমবার, ২১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

অপরাধে ভয়ংকর কিশোর গ্যাং

আলী আজম

অপরাধ সাম্রাজ্যে ভয়ংকর এখন কিশোর গ্যাং। রাজধানীর প্রতিটি এলাকার অপরাধের নেতৃত্ব দিচ্ছে টিনএজ এ গ্যাংয়ের সদস্যরা। শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশেই এরা গ্রুপ তৈরি করে অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে সংগঠিত হয়ে ফেসবুকে, দেয়ালে বা পোস্টারে সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে নিজেদের গ্রুপের নাম জানান দিচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে খুনোখুনিসহ সব ধরনের অপরাধে কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে। তারা মাদক ব্যবসা ও দখলবাজিসহ রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাে  ব্যবহৃত হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধিকাংশ কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার পেছনে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মদদ রয়েছে। এরা প্রথমে হিরোইজম প্রকাশ করতে পাড়া-মহল্লায় গ্যাং তৈরি করে। পরে এসব গ্যাং অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়। আর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার নেপথ্যে রয়েছে আধিপত্য বিস্তার, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমের বিরোধ, মাদক কারবারসহ নানা অপরাধ।

পুলিশ জানায়, সম্প্রতি কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় বড় ভাইয়েরা। প্রথমে তুচ্ছ এবং পরে বড় অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িয়ে পড়ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় এলাকাভিত্তিক অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। তাদের তৎপরতা রোধে প্রতিনিয়ত অভিযান চালানো হচ্ছে।

কিন্তু এদের তৎপরতা বন্ধ হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্কুল-কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে আড্ডা, ইভটিজিং ও মাদকসেবনে পাড়া-মহল্লায় আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং। এরা খুনোখুনি, চাঁদাবাজি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠছে তাতে রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় সবাই তৎপর না হলে এ গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এদের অপরাধের বিস্তার এতটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে যে, আগামীতে কিশোর গ্যাংই হবে নগরবাসীর দুশ্চিন্তার বড় কারণ। বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গড়ে উঠছে এ সব কিশোর গ্যাং। তারা বিভিন্ন অপরাধ সংগঠনের পাশাপাশি নিজেদের একটা জগৎ তৈরি করেছে। পাড়া-মহল্লায় গজিয়ে ওঠা কিশোর গ্যাং নিজেদের তৈরি করা সাংকেতিক ভাষায় তথ্য আদান-প্রদান করে। বিভিন্ন নামে পরিচিত কিশোর গ্যাং আধিপত্য বিস্তার, ছিনতাই, চুরি, পাড়া বা মহল্লার রাস্তায় মোটরসাইকেলের মহড়া, মাদকসেবন ও বিক্রি, চাঁদাবাজি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা এমনকি বিভিন্ন হত্যাকাে র সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।

গত ৯ জুলাই ঢাকার সাভারে কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আকাশ মাহমুদ (২১) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার চর কল্যাণপুরে গ্রামের বাড়ি হলেও ভাড়া থাকতেন সাভারের ব্যাংক কলোনিতে। রাতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক সংলগ্ন সাভারের রাজ্জাক প্লাজার গলিতে কিশোর গ্যাং পিনিক রাব্বি ও হৃদয় গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। আকাশ বাসায় ফেরার পথে তাদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। গত ৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার মাসদাইর বোয়ালিয়া খাল এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় নয়ন সিকদার (১৭) নামে এক কিশোর নিহত হয়। নিহত নয়ন নারায়ণগঞ্জ শহরের গলাচিপা এলাকার জালাল সিকদারের ছেলে। গত ২২ মে রাজধানীর দারুসসালাম থানার লালকুঠি এলাকার বসুপাড়ায় স্কুলছাত্র সিয়াম খানকে (১৪) প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। গত ১০ মে দনিয়া কলেজের সামনে জুনিয়র-সিনিয়র দ্বন্দ্বে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী তাজুন ইসলাম ওরফে মুশফিক (১৮)। ২০১৭ সালের জানুয়ারি উত্তরায় আদনান কবির হত্যার পর কিশোর গ্যাংয়ের কর্মকা  আলোচনায় আসে। ওই সময় থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে ৫২টি কিশোর গ্যাং গ্রুপের ৬৮২ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে রমনায় সাতটি গ্যাংয়ের ১১৩ জন, মিরপুরে ১৩টি গ্যাংয়ের ১৭২ জন, তেজগাঁওয়ে সাতটি গ্যাংয়ের ১২১ জন, উত্তরায় ছয়টি গ্যাংয়ের ৬৪ জন, ওয়ারীতে ছয়টি গ্যাংয়ের ১০৮ জন, গুলশানে সাতটি গ্যাংয়ের ৬৩ জন, মতিঝিলে চারটি গ্যাংয়ের ৩১ জন এবং লালবাগে দুটি গ্যাংয়ের ১০ জন সদস্য সক্রিয় রয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এসব অপরাধী চক্রের নেতা বা সদস্যদের বড় অংশ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। অনেকেই থাকে বস্তিতে। সঙ্গদোষে অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্রও এসব চক্রে জড়িয়ে পড়ে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। যখন যেখানে কিশোর গ্যাং সক্রিয় থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেখানে অভিযান চালানো হচ্ছে। তাদের আটকসহ মামলা করা হচ্ছে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাং সদস্যদের সংখ্যা, নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা হচ্ছে। তাদের পৃষ্ঠপোষক এবং আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদেরও তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। তালিকা অনুযায়ী র‌্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়নকে অভিযান পরিচালনার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অতীতে এ বিষয়ে অনেক অভিযান চালানো হয়েছে এবং আটক করা হয়েছে। গত বছরের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত কিশোর গ্যাংয়ের ৩১৭ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, কিশোর গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িতরা ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে। তাদের ড্রেস কোড থাকে, আলাদা হেয়ার স্টাইল থাকে, তাদের চালচলনও ভিন্ন। নানাভাবে তারা অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে। এলাকার কোনো বড় ভাইয়ের সহযোগী শক্তি হিসেবেও তারা কাজ করে। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ও আছে। সহজ ও অল্প খরচে কিশোরদের দিয়ে তারা অপরাধ করানোর সুযোগ নিচ্ছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিশোর গ্যাং তৈরি করছে। সব শ্রেণিপেশার পরিবারের সন্তান গ্যাং কালচারে জড়াচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ থেকে সরে এসে কিশোররা নানা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর