সোমবার, ২১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

খরচ মেটাতে ধারদেনা

৭৩.৮ শতাংশ নিম্নআয়ের মানুষ সংসার চালাতে ধারদেনা করছেন - সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন নিম্নআয়ের মানুষ

জিন্নাতুন নূর

খরচ মেটাতে ধারদেনা

মাসের খাওয়া ও বাড়ি ভাড়ার খরচ মেটানোর পর নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের হাতে অন্যান্য মাসিক খরচ মেটানোর জন্য আর টাকা থাকছে না। অথচ থাকা-খাওয়ার খরচ ছাড়াও একটি পরিবারের সদস্যদের জন্য চিকিৎসা ও শিক্ষাসহ প্রয়োজনীয় খরচ থেকে যায়। নিম্নআয়ের বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ এসব খরচ মেটাতে ধারদেনা করে এখন জীবন পার করছেন। তারা বন্ধু, পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের কাছে এ টাকা ধার করছেন।

অনেকেই আবার কো-অপারেটিভ সোসাইটি, ব্যাংক ও মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। বস্তি এলাকায় কেউ কেউ জেলাভিত্তিক বিভিন্ন সমিতি থেকে ধার নিচ্ছেন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিং (সানেম)-এর চলতি বছর প্রকাশিত এক জরিপ বলছে, দেশের ৭৩ দশমিক ৮ শতাংশ নিম্নআয়ের মানুষ এখন সংসার চালাচ্ছেন ধারদেনা করে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ বাজারে মধ্যবিত্ত কোনোরকমে চালিয়ে নিলেও দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে নিম্নআয়ের মানুষের। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি- এ ছয় মাস নিম্নআয়ের মানুষের জীবনযাত্রা এবং তাদের আয়-ব্যয়ের তুলনামূলক তথ্য জানতে সানেম-এর জরিপটি পরিচালিত হয়। দেশের আটটি বিভাগের ১ হাজার ৬০০ পরিবার এতে অংশ নেয়। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, গত এক বছরে অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে নিম্নআয়ের মানুষ সঞ্চয় ভাঙছেন। নিম্নআয়ের ৫৫ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ বলছে, গত ছয় মাসের তুলনায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের সঞ্চয় কমেছে। ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ মূল্যস্ফীতির কারণে বাড়তি খরচ মেটাতে আগের সঞ্চিত টাকা ভাঙতে বাধ্য হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অতিরিক্ত দামের সঙ্গে কুলাতে না পেরে নিম্নআয়ের ৪৫ দশমিক ৪২ শতাংশ মানুষ ক্ষুদ্রঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। আর ৩৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ মানুষ বন্ধু, পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের কাছে ধার করছে। গৃহকর্মী পারভীন আক্তার তিনটি বাসায় কাজ করেন। মাস শেষে বেতন পান ৮ হাজার টাকা। তার স্বামী মন্টু মিঞা একটি কিন্ডারগার্টেনে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তার বেতন মাসে ১২ হাজার টাকা। তিন সন্তান নিয়ে পারভীন-মন্টুর টানাটানির সংসার। মিরপুর দুয়ারিপাড়া বস্তিতে মাসের খাওয়ার খরচ ও একরুমের ভাড়া দেওয়ার পর এ দম্পতির হাতে আর টাকা থাকে না। পারভীন বলেন, ‘আমি একটি সমিতির কাছ থেকে টাকা ধার নিয়া বাঁইচা আছি। দুজনের ইনকামে পাঁচজনের সংসার খরচ চলে না। ধারের টাকা দিতে অনেক সময় আরেকজনের কাছে টাকা ধার নিই। সংসারে কারও অসুখ হইলে বিপদে পড়ি। মাইয়া দুইডারে স্কুলে না পাঠাইলেও পোলাডারে স্কুলে পড়াইতাছি।’

ধারদেনায় জীবন চলে রাজধানীর মানিকদি এলাকার নিরাপত্তাকর্মী মো. আবু হাসানেরও। একটি বেসরকারি ব্যাংকের বুথে নিরাপত্তাকর্মী তিনি। মাস শেষে বেতন পান ৭ হাজার টাকা। হাসানের স্ত্রী সুফিয়া অপারেটর হিসেবে কাজ করছেন একটি গার্মেন্ট কারখানায়। ওভারটাইমসহ মজুরি পান ১২ হাজার টাকা। দুই ছেলেকে নিয়ে কোনোরকম খেয়েপড়ে আছে এ পরিবার। হাসান বলেন, ‘আমাদের দুজনের ইনকামের পুরাটাই খাওয়া আর ঘর ভাড়ায় যায়। ছোট ছেলেডার শ্বাসকষ্ট আছে। ওরে ডাক্তার দেখাইতে হয় নিয়মিত, ওষুধ কিনতে হয়।’ হাসানের বড় ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। তার প্রাইভেট পড়ার টাকাও জোগাড় করতে হয়। তিনি আরও বলেন, ‘গ্রামের বাড়িতে অল্প কিছু জমি ছিল সেগুলো বেইচ্যা অনেকদিন খরচ জোগাড় করছি। সেই টাকা শেষ। এখন পরিচিতদের কাছে প্রায়ই টাকা ধার করি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের আয় কমে গেছে। দেশে মুদ্রাস্ফীতি ক্রমাগত বেড়ে গত কয়েক বছরে ১০ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। এটি যদি ১০ থেকে ১৫ বা ২০ শতাংশে চলে যায় তাহলে চরম দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পাবে। এগুলো নির্ভর করে সরকার এ পরিস্থিতিতে কী প্রতিষেধক নেবে তার ওপর। প্রতিষেধক হিসেবে এজন্য সরকার স্বল্পসুদের হারে এ নিম্নবিত্তশ্রেণিকে ঋণ দিতে পারে। কারণ তারা আত্মীয়স্বজনের কাছে বেশিদিন ঋণ পাবে না। এ ছাড়া মাইক্রোক্রেডিট দিয়ে এদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু ঋণ শোধ না করলে মাইক্রোক্রেডিটও আর তাদের দেওয়া যাবে না। এ পরিস্থিতিতে সরকারকে এ শ্রেণির জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয়ের মাধ্যমে ক্যাশ সাপোর্ট দিতে হবে। এটি করা গেলে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মূল্যস্ফীতির ধাক্কা পার করে টিকে থাকবে। আর এমনটি করা না গেলে সমাজে বিক্ষোভ ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।

সর্বশেষ খবর