সোমবার, ২১ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্বকীয়তা হারাচ্ছে মলচত্বর

আফরিদ সাররাফ আলী

স্বকীয়তা হারাচ্ছে মলচত্বর

ক্যালেন্ডারের পাতা ঘুরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মনোরম পরিবেশের কথা চিন্তা করলে অবধারিতভাবেই মলচত্বরের কথা মনে পড়বে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এবং রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের মাঝে মলচত্বরের অবস্থান। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ফ্রান্সের সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আন্দ্রে মালরোর অবদান স্মরণে এ চত্বরটির নামকরণ হয়েছিল। মানুষের মুখে মুখে সময়ের সঙ্গে এই ‘মালরো’ শব্দটিই একসময় ‘মল’ নামে রূপান্তরিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের আলোচনায় এখানকার অনেক স্মৃতিই ভেসে আসে। সম্মান চতুর্থ বর্ষের ঢাবি শিক্ষার্থী তাহসীন নাওয়ার বলেন, ‘একটা ছবি, চোখ জুড়ানো সবুজের মাঝে একটা বড় কৃষ্ণচূড়া। ঠিক যেন বাংলাদেশের পতাকাটাই। এমন একটা ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই মনজুড়ানো সুন্দর সবুজ সৌম্য দৃশ্য দিয়েই ভরা ছিল আমাদের মল চত্বর।’

ঢাবির প্রাক্তন শিক্ষার্থী তামান্না তাসনিম উপমা বলেন, ‘প্রথম বর্ষে আমরা এখানে গ্রুপ স্টাডি করতে আসতাম। মলচত্বরের সকাল ছিল স্বর্গীয়। পাতা পড়ে যাওয়ার দৃশ্য, গাছের ফাঁক গলে আসা রোদ, পাখির কিচিরমিচির, চা খেতে খেতে আড্ডা দেওয়ার স্মৃতিগুলো মনে থেকে গেছে।’ ঢাবির মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আতিকুর রহমান বলেন, ‘একসময় এখানে ক্রিকেট খেলা হতো। ঘাস লাগানোর পর শিক্ষার্থীদের প্রাকৃতিক পরিবেশে নিজেদের বসার একটি জায়গা ছিল এ মলচত্বর।’ অনার্স চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তাবিবুর রহমান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নিয়ে যে চিত্র মাথায় আসত, তা আমি মলচত্বরের মাঝে দেখতে পেতাম।’ অনার্স চতুর্থ বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী নাহিদা সুলতানা সায়মা বলেন, ‘প্রথম বর্ষে ক্লাস শেষে প্রায় প্রতিদিনই মলচত্বরের দিকে হাঁটতে যেতাম। বৃষ্টির দিনে কিংবা ঝড়ের পরে কৃষ্ণচূড়া ফুলে ফুলে যখন মলচত্বরে ছেয়ে যেত তখন শাড়ি পরে ছবি তুলতাম।’ শিক্ষার্থীরা বলছেন, মূলত ঢাবিতে মলচত্বর শিক্ষার্থীদের সতেজ হওয়ার স্থান। একসময় শিক্ষার্থীদের ফুচকা, চটপটি, আইসক্রিম খাওয়ার স্থান ছিল এটি। মনের আনন্দে শিক্ষার্থীরা এখানে সাইক্লিংও করত। ঢাবির দৃষ্টিনন্দন বাসগুলো মলচত্বরে পার্কিং করে রাখা হতো। বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক, হলসহ ক্যাম্পাসের নানা সংগঠনের মিলনমেলা বসত এখানে। খেলাধুলার টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হতো। রোজার সময় ইফতার পার্টির আয়োজন করা হতো এই সবুজ প্রাঙ্গণে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর ১৮ ডিসেম্বর শতবার্ষিক স্মৃতিস্তম্ভের কাজ উদ্বোধন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান, শতবার্ষিক স্মৃতিস্তম্ভের বেদির আয়তন হবে ৭ হাজার ২০০ বর্গফুট। এখানের মূল স্তম্ভের দৈর্ঘ্য ২৫ ফুট। বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের স্মৃতি হিসেবে ১০০ বাতি ও ২০টি হিস্ট্রি প্যানেল তৈরি করা হবে। এখানে শিক্ষার্থীদের বসার জায়গা, সাইকেলস্ট্যান্ড, চার্জিং পয়েন্টসহ অনেক সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে। মলচত্বরের পেভমেন্ট, রোড, ড্রেনেজব্যবস্থা ও বৈদ্যুতিক লাইনের কাজ করা হবে। ফলে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের আবেগের মলচত্বর তার আগের রূপ হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে। ব্যারিকেড দিয়ে মলচত্বরের বিশাল অংশ এখন ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ব্যারিকেড ছাড়াও এখানকার বিস্তীর্ণ এলাকা নির্মাণকাজের জন্য খুঁড়ে রাখায় শিক্ষার্থীদের চলাফেরায় বেগ পেতে হচ্ছে। এর সঙ্গে নির্মাণকাজের শব্দ তো রয়েছেই। গাছগুলো কাটা না হলেও কিছু ক্ষেত্রে গাছের মূল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র জায়েদ উর রশিদ বলেন, ‘হয়তো শতবর্ষী স্তম্ভের নির্মাণকাজ শেষে মলচত্বর এক নতুন রূপ পাবে। সেখানে পানির ফোয়ারা থাকবে, থাকবে নানানরকম কংক্রিটের স্থাপনা, কৃষ্ণচূড়ার লাল রং দিয়ে জায়গাটা আবার শোভিত হবে। শিক্ষার্থীদের পদচারণে স্থানটি আবার মুখরিত হবে, গান হবে, আড্ডা হবে। মোড়ক পাল্টে মলচত্বর আবার শিক্ষার্থীদের মাঝে ফিরে আসবে। মলচত্বরের সৌন্দর্য নিয়ে লেখা হবে কবিতা। কিন্তু পুরনো সেই রূপ শিক্ষার্থীদের মনের মাঝে চিরকালই রয়ে যাবে। তবে প্রশ্ন একটা থেকেই যাবে, মলচত্বর নতুন রূপে হাজির হয়ে আগের মতো শিক্ষার্থীদের মনে কতটা দাগ কাটতে পারবে?’

সর্বশেষ খবর