বৃহস্পতিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা
ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৫০০ ছাড়াল

স্যালাইন সংকটে রোগীরা বিপাকে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডেঙ্গুজ্বরে কাঁপছে দেশ। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ বছর সর্বোচ্চ ৫০৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। রোগীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্যালাইন, ওষুধ ও পথ্যের দাম। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে দেখা দিয়েছে ওষুধ, স্যালাইনের সংকট। বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেওয়া রোগীরা পড়ছেন চরম বিপাকে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে আইভি ফ্লুইড বা স্যালাইনের। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) স্যালাইন ইউনিটটি বন্ধ থাকায় এ সংকট এতটা তীব্র হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পরিস্থিতি সামলাতে ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। অধিদফতরের উপপরিচালক মো. নুরুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনসহ এ-সংক্রান্ত ওষুধের চাহিদা অনেক বেড়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত সপ্তাহে ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। তাদের সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও ওষুধ উৎপাদন করতে বলা হয়েছে। আগে প্রয়োজন অনুযায়ী তারা শিফট পরিচালনা করতেন। এখন তিন শিফটে ওষুধ উৎপাদন করতে বলা হয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি মানুষের প্রয়োজনীয় ওষুধের চাহিদা নিশ্চিত করতে। নিয়মিত রোগী বাড়তে থাকলে এটা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।’ তিনি আরও বলেন, বিস্তীর্ণ এলাকায় ডেঙ্গু রোগী ছড়িয়ে পড়েছে। মার্কেটিং পরিকল্পনার কারণে অনেক সময় কিছু জায়গায় সংকট দেখা দেয়। তাই সংকট নিরসনে একেক ওষুধ কোম্পানিকে একেক জায়গায় ওষুধ সরবরাহ করতে বলা হয়েছে বলে জানান তিনি।

দেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ১ লাখ ছাড়িয়েছে। রোগী বেড়ে যাওয়ায় বাজারে শিরায় দেওয়া স্যালাইন এবং খাওয়ার স্যালাইনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে, সে তুলনায় সরবরাহ নেই। শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিলে, ডায়রিয়া বা কলেরা হলে অথবা কখনো কখনো রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখার জন্য শিরায় দেওয়া স্যালাইন ব্যবহারের পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। হঠাৎ ডায়রিয়া বা কলেরা বাড়লে স্যালাইনের চাহিদা কিছুটা বেড়ে যায়। ডেঙ্গু রোগীদেরও অনেক সময় স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজন হয়। প্রধানত শিরায় দেওয়া স্যালাইন চার ধরনের। এর মধ্যে সাধারণ বা নরমাল স্যালাইন ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। কিছু স্যালাইন থাকে হৃদ?রোগে আক্রান্তদের জন্য। অন্য এক ধরনের স্যালাইনকে বলে গ্লুকোজ স্যালাইন। আবার কলেরার চিকিৎসার জন্য ভিন্ন ধরনের স্যালাইন আছে। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই স্যালাইন উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো স্যালাইনের দাম বাড়িয়েছে। সৃষ্ট হয়েছে সরবরাহের সংকট। আগে যে স্যালাইন বিক্রি হতো ৯০ টাকায়, এখন তা ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। আবার অনেক জায়গায় স্যালাইন পাওয়াই যাচ্ছে না।

সরকারি হাসপাতালে কর্মরত কয়েকজন চিকিৎসক বলেন, রোগীর শরীরে স্যালাইন ঢোকানোর জন্য ক্যানোলা ব্যবহার করা হয়। ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ায় উৎপাদক ও সরবরাহকারীরা ক্যানোলার দাম বাড়িয়েছে। আগে ক্যানোলার যে সেটের দাম ছিল ৪০ টাকা, এখন তা ১৫০ টাকা। এর সঙ্গে দাম বেড়েছে মাইক্রোপ্রোরও (ক্যানোলা স্থাপনে ব্যবহৃত বিশেষ টেপ)। আগে এক বাক্স মাইক্রোপ্রোর দাম ছিল ৬০০ টাকা। এখন ৮০০। বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেওয়া রোগীরা পড়েছেন আরও বিপাকে। গত সপ্তাহে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন রাজধানীর কাকরাইলের বাসিন্দা সাইদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গুজ্বরে তরল খাবারের পরামর্শ দেন চিকিৎসক। আমার স্ত্রী পাঁচ দোকান ঘুরে মাত্র পাঁচ প্যাকেট স্যালাইন কিনতে পেরেছেন। কয়েক গুণ বেশি দামে কিনতে হচ্ছে স্যালাইন। একটা ডাবের দাম ২৫০ টাকায় পৌঁছেছে। অন্য ফলেরও আগুন দাম। পানি খাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’

মিটফোর্ডের হক ফার্মেসির বিক্রয় কর্মী আসিফ আলী বলেন, ‘স্যালাইনের চাহিদা কয়েক গুণ বেড়েছে। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছে ১০০ প্যাকেটের চাহিদা দিলে তারা ৫ প্যাকেট দিচ্ছেন। তাই ৯৫ জন গ্রাহককে ফেরত পাঠাতে হচ্ছে। আগে প্রতিটি ১ হাজার মিলিলিটারের নরমাল স্যালাইন ৯০ টাকায় বিক্রি হতো। এখন ১৫০-১৬০ টাকা। সরবরাহের সংকটে কোথাও কোথাও ৩০০-৩৫০ টাকায়ও স্যালাইন বিক্রি হচ্ছে।’ বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির পরিচালক জাকির হোসেন রনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কোনো স্যালাইনের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বাড়েনি, কিন্তু অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে। বেশির ভাগ কোম্পানিই চাহিদামতো স্যালাইন, ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না। এজন্য বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে। ৮০-৯০ টাকার স্যালাইন ১২০-২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এই সময়ে ডেঙ্গুজ্বর প্রতি বছর হানা দেয়। এই আপৎকালীন সংকট কাটাতে ওষুধ কোম্পানিগুলোর আগে থেকেই পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরও বিষয়টা পর্যালোচনা করতে পারে।’ জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) স্যালাইন ইউনিটটির প্রতিদিন ১২ হাজার ব্যাগ স্যালাইন উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল। কিন্তু উৎপাদনের মানসম্মত চর্চা (জিএমপি) নেই, এমন অভিযোগে ২০২০ সালে ইউনিটটির উৎপাদন বন্ধ করে দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর।

ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৫০০ ছাড়াল : ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৫০৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৬ হাজার ৪২৯ জন। দেশের ইতিহাসে এ বছর সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। চলতি মাসে মৃত্যু হয়েছে ২৫৫ জনের। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গতকাল ডেঙ্গুতে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে আটজন এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালে পাঁচজন মারা গেছেন। একই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২ হাজার ৭০ জন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৮৫৭ এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ১ হাজার ২১৩ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৬ হাজার ৪২৯ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৫১ হাজার ২৭ ও ঢাকার বাইরে ৫৫ হাজার ৪০২ জন।

 দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল গত বছর। চলতি বছর অনেক আগেই সেই রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। গত মাসেই ডেঙ্গুতে ২০৪ জনের মৃত্যু হয়। এর আগে ২০১৯ সালে মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের। এ ছাড়া ২০২০ সালে সাতজন ও ২০২১ সালে মারা যান ১০৫ জন।

ঢাকার বাইরে বাড়ছে রোগী। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল জানান, বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (শেবাচিম) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৪ ঘণ্টায় তিনজন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি মৌসুমে শেবাচিমে ২৪ জনসহ বিভাগে ৩৩ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হলো। স্বাস্থ্য বিভাগের সব শেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত মঙ্গলবার শেরেবাংলা মেডিকেলে ১৮৫ জনসহ বিভাগে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৮১১ জন ডেঙ্গু রোগী। গত মঙ্গলবার শেরেবাংলা মেডিকেলে ১৮৫ জনসহ বিভাগে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৮১১ জন ডেঙ্গু রোগী। এর আগে গত সোমবার বিভাগের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৮৫৬ জন ডেঙ্গু রোগী।

 

সর্বশেষ খবর