বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

আতঙ্ক বাড়াচ্ছে ডাউকি ফল্ট

♦ ফের ভূমিকম্প অনুভূত ♦ ঘন ঘন মৃদু কম্পন আভাস দিচ্ছে বড় বিপর্যয়ের ♦ জনমনে বাড়ছে উদ্বেগ

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

আতঙ্ক বাড়াচ্ছে ডাউকি ফল্ট

ডাউকি ফল্টের চিত্র

বারবার কেঁপে উঠছে সিলেট। বেশির ভাগ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সিলেটের সীমান্তবর্তী ভারতের মেঘালয়ের ডাউকি ফল্ট ও এর আশপাশ এলাকায়। ঘন ঘন মৃদু ও মাঝারি কম্পন বড় ভূমিকম্পের আগাম বার্তা দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ডাউকি ফল্টে (চ্যুতিতে) বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে পুরো সিলেট বিভাগে বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা করছেন তারা। সবশেষ গতকালও সিলেটে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে ভারতের মেঘালয়ে। যা ডাউকি ফল্টের অনতিদূরে। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, গতকাল বেলা ১টা ১৩ মিনিটে অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ৬। সিলেট নগরবাসী বেশ জোরেশোরেই এই কম্পন অনুভব করেন। তবে ভূমিকম্পে কোথাও কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। এর আগে গত ১৪ আগস্ট রাত ৮টা ৪৯ মিনিটে সিলেটে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ওই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলও ছিল সিলেটের সীমান্তবর্তী কানাইঘাট উপজেলা। যা ডাউকি ফল্টের কাছাকাছিই ছিল। রিখটার স্কেলে ওই কম্পনের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫।

সূত্র জানায়, গত ২০ বছরে দেশের অভ্যন্তরে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পের মধ্যে ১৪ আগস্টের কম্পন ছিল সবচেয়ে বেশি মাত্রার। এর আগে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে উৎপত্তি হওয়া সবচেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল ২০০৩ সালের ২৬ জুলাই। যার মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬। এ ছাড়া গত এক বছরে বাংলাদেশে ১৭টি ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ভূমিকম্প ছিল ৫ মাত্রার বেশি। আবহাওয়া অধিদফতর ৫ মাত্রার ভূমিকম্পকে মাঝারি হিসেবে গণ্য করে। ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট ৫ দশমিক ১ ও চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি ৫ দশমিক ২ মাত্রার আরও দুটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। এ ছাড়া বাকি ১৪টি ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ থেকে ৫ এর মধ্যে। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে ডাউকি চ্যুতিরেখায় বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে। গত ১৪ আগস্ট ভূমিকম্পের পর আবহাওয়া অধিদফতরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান রুবায়েত কবির জানিয়েছিলেন, সাধারণত দেশের ভিতরে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ৪ থেকে ৫ এর মধ্যে ছিল। গত ২০ বছরে সাড়ে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হতে দেখা যায়নি। ১৪ আগস্ট হওয়া ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎসস্থলটি ছিল ডাউকি চ্যুতি বরাবর। এই চ্যুতিতে ভূমিকম্প বাড়ছে। এটা ওই এলাকায় বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

২০২১ সালের জুন মাসে ১০ দিনের ব্যবধানে সিলেটে ১০টি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এসব ভূমিকম্পের উৎপত্তি ছিল ডাউকি ফল্টে। এ জন্য সিলেটের স্থানীয় এ ভূমিকম্প নিয়ে বিশেষজ্ঞরাও চিন্তিত। কোনো কোনো ভূমিকম্প সিলেটের একটি নির্দিষ্ট এলাকাজুড়ে অনুভূত হয়েছে। সিলেটের সদর, গোলাপগঞ্জ, বিশ্বনাথ, জৈন্তাপুর ও ছাতকে এই ভূমিকম্পগুলো অনুভূত হয়েছিল। তখন বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, ভূগর্ভে হয়তো মূল ডাউকি চ্যুতির বাইরে কিছু ছোট ছোট চ্যুতির সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ছোট ছোট ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে। যা বড় ভূমিকম্প বা দুর্যোগের আগাম বার্তা বলেও তারা মন্তব্য করেছিলেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত বড় ভূমিকম্পের আগে বা পরে দফায় দফায় মৃদু ও মাঝারি মৃদু কম্পন হতে পারে। তাই ভূমিকম্পের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট। ডাউকি ফল্টে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সিলেটে বড় দুর্যোগ হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর প্রভাব ঢাকায়ও পড়ার আশঙ্কা তাদের। সিলেট সিটি করপোরেশনের তথ্য মতে, সিলেট মহানগরীতে প্রায় ৪২ হাজার ভবন রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জানান, ইতোমধ্যে ৬-৭টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে। কয়েকটি বিপণিবিতানসহ বেশ কিছু ভবন এখনো ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। ভূমিকম্পে বড় বিপর্যয় হলে উদ্ধার কার্যক্রমে সিটি করপোরেশনের কতটুকু প্রস্তুতি রয়েছে জানতে চাইলে নূর আজিজুর রহমান জানান, একসময় সিটি করপোরেশনের কিছুই ছিল না। এখন কিছু যন্ত্রপাতি আছে, কয়েকটি বোলডোজার ও ট্রাক রয়েছে। যেসব স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে তারাও প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কাজে লাগাতে পারছে না। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম গণমাধ্যমকে জানান, ২০২১ সালের মে ও জুনে পরপর ছয় দফা ভূমিকম্পের পর বড় ভূমিকম্পে ক্ষতি কমিয়ে আনতে নগরীর সব বহুতল ভবনের ভূমিকম্প সহনীয়তা পরীক্ষা ও অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় বন্দরবাজার ও জিন্দাবাজার এলাকার কিছু ভবন পরীক্ষা করানো হয়। পরবর্তীতে আর এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি বলেন, সিলেট নগরীর ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ ভবনই ভূমিকম্পের কথা চিন্তা না করে তৈরি করা হয়েছে। ফলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ৮০ শতাংশ বহুতল ভবন ভেঙে পড়তে পারে। ড. জহির বিন আলম বলেন, সব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন যে ভেঙে ফেলতে হবে তা নয়- ঝুঁকিপূর্ণ সব ভবন ভেঙে না ফেলে রেক্টোফিটিংও করা যেতে পারে। সাপোর্টিং পাওয়ার দিয়ে ভূমিকম্প প্রতিরোধক হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের সিলেট ও ভারতের আসাম মিলিয়ে ডাউকি চ্যুতি পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় তিন শত কিলোমিটার বিস্তৃত। এর আগে, ১৮৯৭ সালে ‘ডাউকি ফল্টে’ ৮ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পের উৎস ছিল ঢাকা থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে। সেসময় ভূমিকম্পে আহসান মঞ্জিলসহ ১০টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিলেটে নেমে এসেছিল বিপর্যয়। বেশিরভাগ বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

সর্বশেষ খবর